ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ সময় জুলাই সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব পেয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সংসদ নির্বাচনের বাইরে ‘গণভোট’ আয়োজনের কোনো পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত ইসির নেই। তবে সরকার সিদ্ধান্ত দিলে গণভোট বাস্তবায়নে কমিশন কাজ করবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ।
তিনি বলেন, ‘আমি কমিশনার হিসেবে বলছি না, দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যদি গণভোট করতেই হয়, তাহলে একদিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট করলে কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজও জানিয়েছেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞসহ সবাই একমত হয়েছেন।
বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পঞ্চম দফার বৈঠক শেষে তিনি বলেন, ‘বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে আমাদের যে মতামত দিয়েছেন, জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে সেটি হলো—একটি আদেশ জারি করতে হবে এবং সেই আদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করতে হবে।’
তবে গণভোট কবে ও কীভাবে হবে, তা নিয়ে এখনো ভিন্নমত রয়েছে। কোনো দল জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে, আবার কেউ কেউ জাতীয় নির্বাচনের এক মাস আগেই গণভোট করার পক্ষে মত দিয়েছে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ১২ কোটি ৬৩ লাখের বেশি ভোটার ভোট দেবেন ৪০ হাজারের বেশি কেন্দ্রে, যেখানে ভোটকক্ষ থাকবে আড়াই লক্ষাধিক। প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার এ নির্বাচনে ১০ লাখের বেশি জনবল নিয়োজিত থাকবে। প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরাও ‘আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালট’-এর মাধ্যমে ভোট দিতে পারবেন।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে এক আয়োজনেই দুই কাজ সেরে ফেলা সম্ভব, এতে ব্যয় সাশ্রয় হবে। অন্যথায় একই মাত্রার দুটি আয়োজন করতে হবে।
রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং তার আগে ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণা করার পরিকল্পনা রয়েছে এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন ইসির।
এখন প্রশ্ন উঠেছে—গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত হলে চার মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়নে ইসির সক্ষমতা কতটুকু।
১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতির প্রতি আস্থা যাচাইয়ের জন্য প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। পরেরটি ১৯৮৫ সালে, সামরিক শাসনের বৈধতা দিতে। ১৯৯১ সালে সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে তৃতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ‘এ মুহূর্তে এটি নির্ভর করছে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপর। গণভোটের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় বিষয়। সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা অবশ্যই তা করব। সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসাথে করা সম্ভব। শুধু ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ কিছুটা বাড়াতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। এখন একটা বিষয় জনগণের সামনে তোলা হচ্ছে—জুলাই সনদের প্রশ্নে আপনি পক্ষে দেবেন, না বিপক্ষে দেবেন। যদি জনগণের রায় হয়ে যায়, সেটিই হবে সবচেয়ে বড় শক্তি। প্রয়োজনে সরকার আইন সংশোধন করবে।’
অতীতের তিন গণভোট
স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
-
১৯৭৭ সালের ৩০ মে: রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি জনগণের আস্থা যাচাইয়ে প্রথম গণভোট; ৯৮.৮% ‘হ্যাঁ’ ভোট।
-
১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ: রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নীতি ও পদে থাকার বিষয়ে দ্বিতীয় গণভোট; ৯৪.১১% ‘হ্যাঁ’ ভোট।
-
১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর: সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধন বিল বিষয়ে গণভোট; ৮৪% ‘হ্যাঁ’ ভোট।
আইনগত প্রেক্ষাপট
সংসদ বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট দেওয়াই সবচেয়ে সহজ উপায়।
তিনি বলেন, ‘এতে সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে না, বরং জনগণের কাছে প্রস্তাব রাখা হচ্ছে। তারা অনুমোদন দিলে পরবর্তী সংসদে তা বাস্তবায়ন হবে।’
২০১১ সালে গণভোটের বিধান বাতিল করা হলেও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের আদালতের রায়ে এ বিধান পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয়। অধ্যাপক নিজাম বলেন, ‘সরকার চাইলে জনমত যাচাইয়ের জন্য গণভোট করতে পারে। তবে এজন্য আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সংশোধন করতে হবে এবং ইসিকে গণভোট আয়োজনের নির্দেশ দিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদের ভিত্তিতে সংস্কার এগিয়ে নিতে একবার গণভোট করতে হবে। আর সংবিধান সংশোধনের সময় আবারও গণভোট প্রয়োজন হবে।
ইসির প্রস্তুতি ও চ্যালেঞ্জ
ইসির সাবেক কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, ১৯৯১ সালের গণভোটে মানুষের উপস্থিতি কম ছিল। এবার রাজনৈতিক দলগুলো সহায়তা করলে অংশগ্রহণ বাড়তে পারে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, ‘গণভোট ও সংসদ নির্বাচন আলাদা ব্যালট পেপারে হবে। এজন্য ইসিকে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্স ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’
তিনি মনে করেন, গণভোটে ঐকমত্য তৈরি হলে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ থাকবে না।
গণভোটের বিধানের ইতিহাস
১৯৭২ সালের সংবিধানে গণভোটের বিধান ছিল না। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের ধারা যুক্ত করেন। ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কিছু অনুচ্ছেদ থেকে সেই বাধ্যতামূলক বিধান বাতিল হয়। ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সম্পূর্ণভাবে গণভোটের বিধান তুলে দেওয়া হয়।
তবে ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর আদালতের রায়ে ১৪২ ধারাটি বাতিল ঘোষণা করে গণভোটের বিধান পুনর্বহালের নির্দেশ আসে। তবে এ রায় কার্যকর করতে সংসদে আইন পাসের প্রয়োজন আছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে উঠলে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গেই গণভোট আয়োজন করা সম্ভব—যা সময়, ব্যয় ও প্রশাসনিক প্রস্তুতির দিক থেকে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত বিকল্প হতে পারে।
পূর্বের পোস্ট :