সাড়ে তিন দশক পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (রাকসু) নতুন নেতৃত্ব বেছে নিতে ভোট দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়টি ভবনের ১৭টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে।
রাকসুর ২৩টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ৩০৫ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে থেকে প্রায় ২৯ হাজার ভোটার তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করছেন। একইসঙ্গে অনুষ্ঠিত হচ্ছে হল সংসদ ও সিনেট সদস্য নির্বাচনও।
রাকসুর ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
গত ৩৫ বছরে পদ্মা নদী দিয়ে যেমন অনেক জল গড়িয়েছে, তেমনি এর তীরে গড়ে ওঠা উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতেও এসেছে বড় পরিবর্তন।
রাকসুর ইতিহাস বলছে, একসময় ক্যাম্পাসজুড়ে বামপন্থি সংগঠনগুলোর ব্যাপক প্রভাব ছিল। ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্রমৈত্রীর নেতারা শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আশির দশক পর্যন্ত বামপন্থিদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগও সক্রিয় ছিল। তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে ছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। নব্বইয়ের দশকের শেষ নির্বাচনে ছাত্রদল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে জয় পেয়েছিল।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রভাব শুরু হয়েছিল তখন থেকেই, তবে তা নির্বাচনে অংশগ্রহণেই সীমাবদ্ধ ছিল— নেতৃত্বের স্বাদ তারা পায়নি।
পাল্টে যাওয়া প্রেক্ষাপট
২০২৫ সালের শেষে এসে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই বামপন্থিদের সাংগঠনিক শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে এবং তারা বহু ভাগে বিভক্ত। এবারের নির্বাচনে তাদের উপস্থিতি থাকলেও ইতিহাসের সোনালী সময় ফিরিয়ে আনা কঠিন বলেই মনে করেন শিক্ষার্থীরা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ‘প্রতাপশালী’ ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়েছে, ফলে এবারের নির্বাচনে তাদের প্রাসঙ্গিকতা নেই।
এবার নির্বাচনে এগারটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এর মধ্যে ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবির ছাড়া কেউ পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করতে পারেনি। ‘ডামি প্যানেল’ও রয়েছে আলোচনায়।
রাকসুর ইতিহাসে কখনও জয় না পেলেও ইসলামী ছাত্রশিবির এবার চাঙ্গা অবস্থায় আছে। ডাকসু ও জাকসুর সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফল তাদের উৎসাহ জুগিয়েছে।
শিক্ষার্থীদের ধারণা, এবারের রাকসু নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের মধ্যে। ছাত্রদলের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো অতীতের জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা, কারণ সর্বশেষ নির্বাচনে ভিপি পদে জয় পেয়েছিল তাদের প্রার্থী।
দলীয় প্যানেলের বাইরেও রয়েছেন কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী, যাদের ভালো সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে জুলাই-অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় যারা সক্রিয় ছিলেন এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের ক্যাম্পাসে জোরালো সমর্থন রয়েছে।
ভোট তথ্য
সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত নয়টি ভবনের ১৭টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলবে
ভোট শেষে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে ফলাফল ঘোষণা করা হবে
মোট ভোটার ২৮ হাজার ৯০১ জন— নারী ১১ হাজার ৩০৫ এবং পুরুষ ১৭ হাজার ৫৯৬
রাকসুর ২৩টি পদে মোট প্রার্থী ৩০৫ জন
১৭টি হল সংসদের ২৫৫টি পদে প্রার্থী ৫৫৫ জন
সিনেটের পাঁচটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৫৮ জন
ভোট পরিচালনায় দায়িত্বে রয়েছেন ২১২ জন শিক্ষক ও কর্মকর্তা
নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য
নির্বাচন কমিশন মনে করছে, এই নির্বাচন শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চা, নেতৃত্ব বিকাশ এবং দায়িত্ববোধ গঠনের অসাধারণ সুযোগ এনে দিয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া। তাই প্রতিটি ধাপে নির্বাচনকে বিতর্কমুক্ত রাখতে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।
“আইন-শৃঙ্খলা, ভোটার, প্রার্থী ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি মোতায়ন করা হয়েছে।”
রাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাই ভোটার হতে পেরেছেন। ভোটার হলেই রাকসু বা হল সংসদে প্রার্থী হওয়া যায়।
ভোট প্রক্রিয়া
নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ জানান, একজন ভোটার নির্দিষ্ট কেন্দ্রে প্রবেশ করে পোলিং কর্মকর্তার কাছে সই দিয়ে ছয়টি ব্যালট পেপার নেবেন। গোপন বুথে ভোট প্রদান শেষে ব্যালটগুলো স্বচ্ছ বাক্সে ফেলতে হবে।
প্রথম ব্যালট পেপারে থাকবে সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদপ্রার্থীর তালিকা।
দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ব্যালটে বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদপ্রার্থীর নাম থাকবে।
পঞ্চম ব্যালটে সিনেট সদস্য পদপ্রার্থীদের নাম এবং ষষ্ঠ ব্যালটে হল সংসদের প্রার্থীদের নাম থাকবে।
পূর্বের পোস্ট :