শান্তিপূর্ণ ভোট শেষে অভিযোগ–পাল্টা অভিযোগের মধ্যেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে একচেটিয়া জয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর অনুষ্ঠিত এই ভোটের মধ্য দিয়ে দেশের তিনটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নেতৃত্বই এখন জামায়াতে ইসলামীর এই ছাত্র সংগঠনের হাতে গেল। ৪৪ বছর পর চাকসুতে প্রত্যাবর্তন ঘটল তাদের।

বুধবার ভোট শেষের ১২ ঘণ্টা পর ভোর পৌনে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের মিলনায়তনে ফল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন। জনাকীর্ণ মিলনায়তনে জয় উদযাপনে ফেটে পড়েন শিবিরের নেতাকর্মীরা।

শিবিরের একচ্ছত্র আধিপত্য

ফল ঘোষণায় দেখা যায়, কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬টি পদের মধ্যে ২৪টিতেই জয় পেয়েছে শিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থীরা। ভিপি ও জিএসসহ শীর্ষ দুটি পদও গেছে তাদের দখলে।

ভিপি পদে ইতিহাস বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণ ছাত্রশিবিরের সভাপতি ইব্রাহীম হোসেন রনি পেয়েছেন ৭,৯৮৩ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় পেয়েছেন ৪,৩৭৪ ভোট।

জিএস পদে ইতিহাস বিভাগেরই ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সাহিত্য ও মানবাধিকার সম্পাদক সাঈদ বিন হাবিব পেয়েছেন ৮,০৩১ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের মো. শাফায়াত হোসেন পেয়েছেন ২,৭২৪ ভোট।

এজিএস পদে অবশ্য জয় পেয়েছেন ছাত্রদলের আইয়ুবুর রহমান তৌফিক। তিনি ৭,০১৪ ভোট পেয়ে শিবিরের সাজ্জাত হোছন মুন্নাকে (৫,০৪৫ ভোট) পরাজিত করেন।

সহ–খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছেন ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থী তামান্না মাহফুজ স্মৃতি।

ভোটের চিত্র

নগরী থেকে দূরে পাহাড় ঘেরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজার ৫১৬ ভোটারের মধ্যে ৬৫ শতাংশ ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

সকাল ৯টার সময় ভোটগ্রহণ শুরুর কথা থাকলেও বিলম্বে শুরু হয় সাড়ে ৯টার দিকে। দৃষ্টিহীন ভোটারদের ভোট শুরু হয় আরও দেরিতে, বেলা সাড়ে ১১টায়।

ভোটার চিহ্নিত করার কালি অমোচনীয় নয়— এমন অভিযোগ তোলে কয়েকটি প্যানেল। একইসঙ্গে বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়েও ওঠে অভিযোগ। আইটি ফ্যাকাল্টিতে ব্যালট বাক্সে স্বাক্ষরবিহীন ১২টি ব্যালট পাওয়ার কথাও জানা যায়।

ভোট শেষে পাঁচটি কেন্দ্রে মেশিনে গণনা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি সেল পুনরায় গণনা করে ফল মেলানো হয়। ফল মিলে যাওয়ার পর ঘোষণা করা হয় আনুষ্ঠানিক ফলাফল।

প্রশাসনের ভূমিকা ও নিরাপত্তা

উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার ভোটের দিন সকালে কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরির এবং রিহার্সাল হিসেবে বিবেচিত হবে।’

ভোট উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ভোট শেষের পর ফল গণনার আগে ছাত্রদল ও শিবিরের মধ্যে উত্তেজনার খবরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।

অভিযোগ ও প্রতিক্রিয়া

ডাকসু ও জাকসুর নির্বাচনের মতো এখানেও ছাত্রদল অভিযোগ করেছে ভোটের অনিয়ম ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের। তবে আগের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো চাকসুর ফল বর্জন করেনি তারা।

এবারের নির্বাচনে ১৩টি প্যানেল অংশ নেয়— আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ মিলে। কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৪১৫ জন প্রার্থী (পুরুষ ৩৪৮, নারী ৪৭ জন)। অন্যদিকে ১৪টি হল ও একটি হোস্টেলের ২০৬ পদে প্রার্থী ছিলেন ৪৯৩ জন।

ইতিহাসে ফিরে দেখা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে, আর সর্বশেষটি হয়েছিল ১৯৯০ সালে।

১৯৭০: ভিপি ছাত্রলীগের মোহাম্মদ ইব্রাহীম, জিএস আবদুর রব

১৯৭২: ভিপি ছাত্র ইউনিয়নের শামসুজ্জামান হীরা, জিএস জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না

১৯৭৪: ভিপি এস এম ফজলুল হক, জিএস গোলাম জিলানী চৌধুরী (জাসদ ছাত্রলীগ)

১৯৭৯: ভিপি মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী (জাসদ ছাত্রলীগ), জিএস জমির চৌধুরী (ছাত্রলীগ)

১৯৮১: ভিপি জসিম উদ্দিন সরকার, জিএস আবদুল গাফফার (ইসলামী ছাত্রশিবির)

১৯৯০: ভিপি নাজিম উদ্দিন (জাতীয় ছাত্রলীগ), জিএস আজিম উদ্দিন আহমদ (ছাত্রফ্রন্ট)

নতুন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি

গণঅভ্যুত্থান–পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগবিহীন এই চাকসু নির্বাচনে শিবির ও ছাত্রদলের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও ফলাফলে ব্যবধান ছিল ব্যাপক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাকসু) নির্বাচনে জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে এবার চাকসুতেও নেতৃত্বের আসনে ফিরল ইসলামী ছাত্রশিবির— প্রায় সাড়ে চার দশক পর।