জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জোবায়েদ হোসেন হত্যায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।

পুরান ঢাকার আরমানিটোলা এলাকার পানির পাম্প গলির একটি ছয়তলা ভবনের তিনতলার সিঁড়ি থেকে রবিবার রাতে জোবায়েদের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

যে ভবন থেকে জোবায়েদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, সেখানের একটি ফ্ল্যাটে টিউশনি করাতেন জবি শিক্ষার্থী।

জোবায়েদ ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগে ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।

জবি শিক্ষার্থীরা জানান, এলাকাবাসী ভবনের তিনতলার সিঁড়িতে জোবায়েদের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখে। তার গলায় ছুরির আঘাত আছে। শরীরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্সি দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ দিলে শিক্ষার্থী এবং ছাত্রদলের কর্মীরা এসে জোবায়েদকে শনাক্ত করে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন জানান, জোবায়েদকে ভবনের নিচে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। সাহায্যের জন্য জোবায়েদ আহত অবস্থায় ভবনের তিনতলা পর্যন্ত উঠলেও সিঁড়িতে পড়ে যান এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত সিঁড়িতে রক্তের দাগ দেখা গেছে বলে জানান তারা।

আরমানিটোলা পুরান ঢাকার বংশাল থানার আওতাধীন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ফরেনসিক টিম আসার পরে পুলিশ জোবায়েদের মরদেহ উদ্ধার করে। কী কারণে জোবায়েদের গলায় ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানে না পুলিশ।

“পুরো বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে,” জানান রফিক।

জোবায়েদের সহপাঠীরা জানিয়েছেন, ভবনের একটি ফ্ল্যাটে এইচএসসি পরীক্ষার্থী একটি মেয়েকে পড়াতেন জোবায়েদ। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মেয়েটির যোগসাজশ আছে বলে ধারণা করছেন তারা।

ইতোমধ্যে এইচএসসি পরীক্ষার্থী সেই মেয়েটিকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশ এবং ছাত্রদলের পাহারায় মেয়েটিকে বংশাল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেয়েটিকে পুলিশের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়ার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম।

উপস্থিত বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী এবং ছাত্রদল কর্মীদের প্রতি তিনি আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানান। তবে অভিযুক্ত মেয়েটিকে থানায় নেওয়ার আগেই থানার মূল ফটক ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা। পরে অভিযুক্তকে বিকল্প পথে থানায় নেওয়া হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাতেই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।

“আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাই আইনের হাতে অভিযুক্তকে তুলে দিয়েছি। কিন্তু জোবায়েদের মূল হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে,” বলেন রাকিব।

সহপাঠী হত্যায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শুরুতে বাহাদুর শাহ পার্ক, শাঁখারিবাজার মোড়, জর্জ কোর্ট মোড়ে বিক্ষোভ করেন। মধ্যরাতে তারা তাঁতিবাজার সড়ক অবরোধ করেন। শিক্ষার্থীদের একাংশ মাঝরাত পর্যন্ত বংশাল থানা ঘেরাও করে থানার সামনে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে। এ সময় শিক্ষার্থীদের জোবায়েদের হত্যার বিচারের দাবিতে ক্ষুব্ধ স্লোগান দিতে দেখা যায়।

শিক্ষার্থীদের একাংশের দাবি, জোবায়েদের হত্যার সঙ্গে দুজন জড়িত। জোবায়েদকে ছুরিকাঘাত করার পরপরই তাদেরকে দৌড়ে বংশাল থেকে পালাতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

সিসিটিভির ফুটেজে বিকেল ৪টা ৩৯ মিনিটে বংশালের নূরবক্স রোডে কালো ও লাল টি-শার্ট ও পিঠে কালো ব্যাগ নিয়ে দুই যুবককে দৌড়ে বংশাল রোডের দিকে যেতে দেখা গেছে। পুলিশের ধারণা, এ দুজনই জোবায়েদ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ জোনের উপকমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী জানিয়েছেন, শনাক্ত করা এই দুজনকে ধরতে মাঠে পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে।

“ভবনের সব বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আটক করা মেয়েটিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই জোবায়েদ হত্যার প্রকৃত কারণ উদঘাটন করতে সক্ষম হবে পুলিশ,” বলেন তিনি।

এদিকে জোবায়েদ হত্যার প্রতিবাদে মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে ঢাবি শাখা ছাত্রদল। টিএসসি থেকে মিছিল শুরু হয়ে ভিসি চত্বর, হলপাড়া ঘুরে আবার টিএসসিতে ফিরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে ছাত্রদল।

ঢাবি ছাত্রদল সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস জানান, জোবায়েদ ছিলেন জুলাই-আগস্টের সম্মুখ সারির যোদ্ধা। বর্তমান ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ বলে অভিযোগ করেন তিনি।

“জোবায়েদ হত্যার বিচার না হলে আমরা আরও কঠোর আন্দোলনের ডাক দেব। শুধু বিক্ষোভ সমাবেশ করে ছাত্রদল থামবে না,” বলেন গণেশ।

এদিকে জোবায়েদ হত্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কবি জসীমউদ্দীন হলের ছাত্রদলের আহ্বায়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী তানভীর বারী হামিম বলেন, “সাম্য হত্যার বিচার পাইনি। পারভেজ হত্যার বিচার মেলেনি। জোবায়েদ হত্যার বিচার পাব কি না সন্দেহ আছে।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন জানিয়েছে, পুলিশের প্রতিবেদন হাতে পেয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

প্রক্টর মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক বলেছেন, “পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন তদন্ত করছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়ে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবে বিশ্ববিদ্যালয়।”

আরমানিটোলায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জোবায়েদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম।

দ্রুত দোষীদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।