দেশে বড় অগ্নিকাণ্ডগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে দীর্ঘ সময় লাগছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে ফায়ার সার্ভিসে খবর পৌঁছাতে দেরি, যানজটের ভোগান্তি, আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি—আর এখন যোগ হয়েছে ‘রাসায়নিকের ভয়’।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, অনুমোদনহীন গোপন রাসায়নিক মজুতের কারণে গত কয়েক বছরে বহু সহকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। এজন্য এখন তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কিছুটা সময় নিচ্ছেন।

যদিও এই বিলম্বকে ‘সময়ক্ষেপণ’ নয়, বরং ‘বিচক্ষণতা’ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফায়ার সার্ভিসের দাবি, রাসায়নিকের আগুন নেভানোর মতো প্রশিক্ষিত জনবল ও আধুনিক সরঞ্জাম এখনও পর্যাপ্ত নয়।

গত পাঁচ দিনের ব্যবধানে বড় তিনটি অগ্নিকাণ্ডে একই ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

গত মঙ্গলবার ঢাকার মিরপুরে রাসায়নিক গুদাম ও পোশাক কারখানায় লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে ১৯ ঘণ্টা পর; প্রাণ হারান ১৬ জন। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের সিইপিজেডে কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে ১৭ ঘণ্টায়, পুরোপুরি নেভে ৪৮ ঘণ্টা পর। শনিবার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে সাত ঘণ্টায়, কিন্তু পুরোপুরি নেভে ২৭ ঘণ্টা পর।

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান বলেন, “যেখানে আগুন লাগে, সেখানে প্রাথমিকভাবে নিজস্ব ফায়ার ফাইটিংয়ের ব্যবস্থা থাকা উচিত। আমরা পৌঁছাতে ১৫–২০ মিনিট সময় নিই, ততক্ষণে আগুন বড় হয়ে যায়।”

চট্টগ্রামের সিইপিজেডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী জানান, কল পেতে দেরি, যানজট ও টিটিএল গাড়ি প্রস্তুত করতে সময় লেগে যাওয়ায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, “মিরপুরের আগুন ছিল রাসায়নিক গুদামের। এমন দাহ্য বস্তু থাকলে আগুনের তীব্রতা বহুগুণ বেড়ে যায়। তবে ফায়ার সার্ভিসের নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন নেই, লোকবল বাড়াতে হবে।”

ফায়ার সার্ভিসের আরেক সাবেক মহাপরিচালক আবু নাঈম মো. শহিদউল্লাহ বলেন, “পরিস্থিতি বুঝে কাজ শুরু করা দুর্বলতা নয়, এটা বুদ্ধিমানের কাজ। নিরাপত্তাই প্রথম।”

বিমানবন্দরের আগুনে অব্যবস্থা

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, কার্গো ভিলেজে আগুন লাগা অংশে স্টিলের স্ট্রাকচার ও খোপখোপ অংশ থাকায় নির্বাপণে সময় লেগেছে। সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানবন্দরের অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল, হাইড্রেন্ট অচল, পানি সরবরাহেও ছিল সমস্যা।

কেন এত ঘন ঘন আগুন

অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, “আমাদের ভবনগুলোতে কাঠামোগত দুর্বলতা ও ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি নেই। উন্নত দেশে আগুন লাগে, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি কম হয়; এখানে তা হয় না।”

তিনি ‘রিস্ক রিডাকশন’ ও নিজস্ব ফায়ার সিস্টেম স্থাপনের ওপর জোর দেন।

আলী আহম্মেদ খান বলেন, “যন্ত্রপাতি বাড়াতে হবে, তবে প্রশিক্ষণ আরও জরুরি। ফায়ার ফাইটাররা দেখে-ঠেকে শিখছেন; দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।”

একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের পেছনে নাশকতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেননি কেউ কেউ। আলী আহম্মেদ খান বলেন, “এয়ারপোর্টে রেসপন্সে সময় লাগল কেন, তা তদন্তে দেখা উচিত।”

আরেক সাবেক মহাপরিচালক আবু নাঈম মো. শহিদউল্লাহ বলেন, “পরপর তিনটি অগ্নিকাণ্ডে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। নাশকতার সম্ভাবনা মাথায় রেখে তদন্ত এগিয়ে নিতে হবে।”