জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশে স্পষ্ট রাজনৈতিক টানাপোড়েনে পড়েছে বিএনপি। দলটি গত দুই দিনে কমিশনের কিছু সুপারিশের কড়া সমালোচনা করলেও সরাসরি প্রত্যাখ্যানের অবস্থান নিতে পারেনি।
দলের নীতিনির্ধারণী সূত্র ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশগুলো বিএনপিকে এমন এক বেকায়দায় ফেলেছে—দলটি মেনে নিতে পারছে না, আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারছে না। কারণ, প্রত্যাখ্যান করলে নির্বাচন বানচালের অজুহাত তৈরি হতে পারে। এতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বিএনপিকে ‘সংস্কারবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ পেতে পারে। আর মেনে নিলে সেটি বিএনপির জন্য রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে দেখা দিতে পারে।
দলের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখালে বিএনপিকে সংস্কারে ‘বাধা সৃষ্টিকারী’ শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হবে। এই পরিস্থিতিতে গত দুই দিনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে স্থায়ী কমিটির নেতাদের একাধিক বৈঠক হয়েছে। তবে এখনো সংকট থেকে বের হওয়ার কৌশল নির্ধারণ করা যায়নি।
দলীয় নেতাদের ধারণা, এখনই প্রতিক্রিয়ায় না গিয়ে সংযমী অবস্থান নিয়ে সরকারের ওপর পাল্টা চাপ তৈরির কৌশল নেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল শিগগির জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবছে। সেখানে আপত্তির বিষয়গুলো তুলে ধরে সমাধানের দাবি জানানো হবে।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপির স্থায়ী কমিটি। আগের দিন রাতে দলের স্থায়ী কমিটির সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত জানাতে এই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রত্যাখ্যানের কথা তো আমরা বলিনি।’
আরেক প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানাবেন কি না—এর জবাবে ফখরুল বলেন, ‘নালিশের কী আছে এটা? আমরা আমাদের মতামত জাতির সামনে তুলে ধরলাম। প্রয়োজনে আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে আবার যাব।’
সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মতে, এখন দলটির একমাত্র লক্ষ্য নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকার ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি চায় নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হোক। তবে দলটির অভিযোগ, সরকার ও ঐকমত্য কমিশন বিএনপির এই আগ্রহকে দুর্বলতা হিসেবে নিয়েছে।
বিএনপির অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, সরকার ‘জুলাই জাতীয় সনদ’কে দুই ধাপে ভাগ করেছে—প্রথম ধাপে সনদ প্রণয়ন ও দ্বিতীয় ধাপে বাস্তবায়নের সুপারিশ। বিএনপি ভেবেছিল, ভিন্নমতসহ সব প্রস্তাব এতে স্থান পাবে। কিন্তু বাস্তবায়নের সুপারিশে গণভোটের সময়, ভিন্নমতের উল্লেখ না করা এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন—এই তিন বিষয়ে দলের আপত্তি রয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এসব প্রস্তাবের বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘সিদ্ধান্তটা না দেখে অন্ধভাবে সাইন করা ঠিক হয়নি। বিএনপি খেলতে গিয়ে ভুল করেছে, এখন সে ভুল অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে।’
বেকায়দায় বিএনপি
সব মিলিয়ে সংস্কার বাস্তবায়নের প্রশ্নে বিএনপি এখন উভয়সংকটে—প্রত্যাখ্যান করলে ‘সংস্কারবিরোধী’, আর মেনে নিলে ‘পরাজিত’। দলটি আপাতত কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। পাশাপাশি কমিশনের দিক থেকে আলোচনার নতুন উদ্যোগ এলে তাতে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা রোগীটি (দেশ) বাঁচাতে চাই। নির্বাচনটা হোক, নির্বাচনে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, এটাই বিএনপির চাওয়া।’
বিশ্লেষকদের মত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিএনপি এখন কৌশলগত সংযমে আছে—সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন তুললেও প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের আলাদা করছে না। তবে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে বিএনপির অবস্থান কতটা কার্যকর হবে।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বিএনপি এক চাপে পড়েছে। তারা সংস্কারবিরোধী হতে চায় না, আবার সব প্রস্তাবও মানতে পারছে না। ফলে একধরনের রাজনৈতিক অস্বস্তিতে আছে দলটি।’ তিনি মনে করেন, কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশগুলোতে পরিমার্জনের সুযোগ আছে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’–‘না’ উপস্থাপনের প্রক্রিয়াও বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।
পূর্বের পোস্ট :