গাজা এমন এক বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়েছে, যেখানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও থামছে না রক্তপাত—এমন সতর্কবার্তা দিয়েছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল আনসারি।

তিনি গাজায় দ্রুত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন ও প্রশাসন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের পথ সুগম হয়।

আনসারি বলেন, ‘আমরা এমন এক অবস্থায় যেতে চাই না যেখানে না যুদ্ধ, না শান্তি—এই দুয়ের মাঝখানে গাজা ঝুলে থাকে।’

রক্তাক্ত দিন

মঙ্গলবার গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৬৬ জন নারী ও শিশু। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করার পর এটিই ছিল গাজার সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিন।

ইসরায়েল জানিয়েছে, রাফা শহরে তাদের এক সেনা নিহত হওয়ার প্রতিশোধে এই হামলা চালানো হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাহিনীর প্রস্তাব

চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে গাজায় আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের কথা বলা আছে, যাতে সহিংসতা কমে এবং ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও হামাসের নিরস্ত্রীকরণের প্রক্রিয়া এগিয়ে যায়।

‘দ্য গার্ডিয়ান’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আনসারি বলেন, আন্তর্জাতিক বাহিনী ও নতুন ফিলিস্তিনি প্রশাসন দ্রুত গঠিত না হলে বর্তমান যুদ্ধবিরতি স্থায়ী শান্তিতে রূপ নেবে না।

তিনি বলেন, ‘এখনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ন, পুনর্গঠন ও শান্তিরক্ষার কাজ শুরু করতে হবে। এটিই যুদ্ধ থেকে পরবর্তী দিনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ।’

গাজার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে ২০ দফা পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক বাহিনীর কাঠামো ও ভূমিকা এখনো স্পষ্ট নয়। কাতার ও তার আঞ্চলিক মিত্ররা চায়, জাতিসংঘের সমর্থনে এই বাহিনী গঠিত হোক। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওও জানিয়েছেন, ওয়াশিংটন সেই সম্ভাবনা বিবেচনা করছে।

আনসারি বলেন, ‘যদি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব ও গাজার জন্য ম্যান্ডেট পাওয়া যায়, তাহলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা সম্ভব হবে।’

তবে তিনি সতর্ক করেছেন, আন্তর্জাতিক বাহিনীর মোতায়েন ও দায়িত্ব নির্ধারণ জটিল প্রক্রিয়া, যা সম্পন্ন হতে সপ্তাহ বা মাস লেগে যেতে পারে—আর এতটা সময় গাজার হাতে নেই।

যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগ

গাজায় প্রতিদিনই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলছে। আনসারি বলেন, ‘প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার আগেই নানা চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। নিহত জিম্মিদের মরদেহ শনাক্তের কাজ ও ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু এখনও চলছে।’

এদিকে, গাজায় এখনও ১১ জন জিম্মির মরদেহ রয়েছে, বৃহস্পতিবার হামাস ফিরিয়ে দিয়েছে দুইজনের দেহাবশেষ।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা

যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রশংসা করে আনসারি বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখতে সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণই ভারসাম্য রক্ষা করেছে।’

ট্রাম্প এই চুক্তিকে ‘ইতিহাসে স্মরণীয়’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে অনুরূপ প্রস্তাব গত বছরও আলোচনায় ছিল, কিন্তু এপ্রিল ২০২৪-এ নিজ জোটের চাপে পিছু হটেছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

কাতারের অবস্থান

আনসারি জানান, গত সেপ্টেম্বরে দোহায় হামাস নেতাদের বৈঠকে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ছয়জন নিহত হন, যাদের মধ্যে একজন কাতারি নাগরিকও ছিলেন। তাঁর দাবি, এ হামলার উদ্দেশ্য ছিল কাতারের কূটনৈতিক ভূমিকা দুর্বল করা।

এই ঘটনার পর কাতার যুক্তরাষ্ট্রকে জানায়, ইসরায়েল থেকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত তারা আলোচনায় ফিরবে না। পরে ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে নেতানিয়াহুকে কাতারের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন, এরপর আবার আলোচনায় ফেরে সব পক্ষ।

আনসারি বলেন, ‘কাতারের লক্ষ্য ছিল তিনটি—যুদ্ধ থামানো, রক্তপাত বন্ধ করা; দখল রোধ করা; এবং গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ প্রতিরোধ করা। চূড়ান্ত চুক্তিতে আমরা এই তিনটি বিষয়ই নিশ্চিত করেছি।’

তবে, গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসন ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রগঠনের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি এখনো নেই—যেটি নেতানিয়াহুর সরকার বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছে।