ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ থামলেও শুকায়নি দুই বছরের ক্ষত, মিলিয়ে যায়নি বারুদের গন্ধ। নিজ আবাসে ফিরে গাজাবাসী দেখছে— এতদিনের সাজানো সংসার, সুউচ্চ অট্টালিকা এখন নিদারুণ ধ্বংসস্তূপ।

সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গাজাবাসীর মর্মান্তিক জীবনের করুণ চিত্র। শহরে থাকার মতো জায়গা না পেয়ে প্রায় এক লাখ গাজাবাসী ঠাঁই নিয়েছেন গোরস্তানে।

গোরস্তানে তাবু গেড়ে বসবাস করছেন তারা। নেই পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয়, নেই পরিবারের স্বজনদের ন্যূনতম নিরাপত্তা। শিশুরা এতদিন বোমা-বারুদের পর এবার বড় হচ্ছে গোরস্তানের থমথমে পরিবেশে।

গাজার বাসিন্দা রামি মুসলেহ, ১২ সন্তানের জনক। নিজের সন্তানদের গোরস্তানে বড় করার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, “মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ের পর এবার মানসিক কষ্টের মধ্যে বড় হচ্ছে শিশুরা। পুরো যুদ্ধ তাদের মনের ওপর যে নেতিবাচক ছাপ ফেলেছে, গোরস্তানে বসবাসের কারণে সেই ক্ষত এখন চিরস্থায়ী রূপ নিচ্ছে।”

গাজাবাসীরা জানান, শহরে শুধু ধ্বংসস্তূপ আর বিধ্বস্ত অট্টালিকা। মাথা গোঁজার মতো সামান্য ঠাঁইও নেই। ভেঙে পড়া ভবনের ইট-পাথরের মধ্যে থাকা অসম্ভব বলে বাধ্য হয়েই তারা আশ্রয় নিয়েছেন গোরস্তানে।

কাছ থেকে যুদ্ধ দেখেছেন বিদীর্ণ এই শহরের অধিবাসী সাবাহ মুহাম্মদ। আফসোস করে তিনি বলেন, “শুধু মৃতদের জন্য বরাদ্দ এই মাটিতেই এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে হাজার হাজার গাজাবাসীর। গোরস্তান ছিল এতদিন পবিত্র এক জায়গা। মৃতদের জন্য নির্ধারিত এই স্থানে এখন এসে আশ্রয় নিয়েছে জীবিতরা। যারা বেঁচে আছে, তাদের ক্ষতের সাক্ষী এই কবরের মৃতরা।”

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, দুই বছরের ইসরাইলি গণহত্যা ও লাগাতার হামলায় গাজায় উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯০ হাজারের বেশি। বেঁচে থাকার তাগিদে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছেন তারা। এমন অনেকে আছেন, যাদের অন্তত ১০ বারের বেশি স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে।

গাজার উত্তরাঞ্চল পুরোপুরি দখলে নিতে দিনরাত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে ইসরাইল। জীবন বাঁচাতে মানুষ ছুটেছে দক্ষিণাঞ্চলে। তুলনামূলকভাবে নিরাপদ দক্ষিণাঞ্চলের এক বর্গমিটার মাটির ভাড়াও দেওয়ার সামর্থ্য নেই অধিকাংশ গাজাবাসীর। তাবু খাটিয়ে থাকার সুযোগ না থাকায় শেষ পর্যন্ত তাদের ঠিকানা হয়েছে গাজার বিভিন্ন গোরস্তান।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজায় ধ্বংসস্তূপের পরিমাণ ৬১ মিলিয়ন টন। এই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে গাজাকে বাসযোগ্য করতে লাগবে দীর্ঘ সময়। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই প্রতিদিন দেখা যায় গাজাবাসীকে খোঁজাখুঁজি করতে— যদি পাওয়া যায় বেঁচে থাকার মতো কোনো জিনিস, শুকনো খাবার কিংবা তাবুতে নিয়ে আসার উপযোগী কিছু।

১০ অক্টোবর থেকে যুদ্ধবিরতি চললেও ইসরাইল এখনো গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে দিচ্ছে একের পর এক বাধা। শহরের প্রায় প্রতিটি বাসিন্দা এখন এই সহায়তার ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। এত বাধা-বিপত্তির মাঝেও বেঁচে থাকার, টিকে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গাজাবাসীরা।