গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার কারণে ‘সুমুদ’ শব্দটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। আরবি শব্দ ‘সুমুদ’ অর্থ দৃঢ়তা, অটল থাকা বা অধ্যবসায়। সাধারণত কঠিন পরিস্থিতিতেও ফিরে দাঁড়ানোর মানসিকতাকে সুমুদ বলা হয়। তবে প্রায় আট দশক ধরে ইসরায়েলের দখলদারি ও আগ্রাসনের মুখে ফিলিস্তিনিদের জীবনে সুমুদ শুধু অর্থ নয়; এটি জাতীয় চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের আগমনের পর থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ ও বিতাড়নের ইতিহাস কমপক্ষে ১০০ বছরের। বিশেষ করে ১৯৪৮ সালের ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় এক বছরে ৫৩০টি গ্রাম ও শহর ধ্বংস, ১৩ হাজার মানুষ নিহত এবং সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হন। এই ঘটনার স্মৃতি ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয় হিসেবে পরিচিত। পরে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিম তীর, গাজা, জেরুজালেমসহ অন্যান্য অঞ্চল দখল করে ইসরায়েল। এ সময়ে প্রায় তিন লাখ ফিলিস্তিনি পুনরায় বাস্তুচ্যুত হন, যা ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকসা’ বা মহাপ্রত্যাঘাত নামে পরিচিত।

প্রাথমিকভাবে সুমুদ বলতে বোঝানো হতো নিজের ভূমি বা ঘর-বসতি ছেড়ে না যাওয়া এবং হামলা উপেক্ষা করে স্থায়ী থাকা। ফিলিস্তিনিরা ঘর-বাড়ি পুনর্নির্মাণ, বোমা বিধ্বস্ত স্থানে ফিরে যাওয়া ও উপার্জনের উৎস যেমন জলপাইগাছ রোপণ করে পুনরুদ্ধার করাকে ‘আস-সুমুদস সাকিনু’ বা অটল স্থিরতা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

১৯৬০-৭০-এর দশকে জর্ডান ও লেবাননের শরণার্থী শিবিরগুলোতে জাতীয় চেতনা জাগানোর জন্য প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতো। তখনকার বসবাসকারীরা ‘সামিদিন’ বা দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৮ সালে পিএলও ‘সুমুদ সহায়তা তহবিল’ গঠন করে বাস্তুচ্যুতদের ফিলিস্তিনে অটল থাকার সহায়তা প্রদান করেছিল।

পরবর্তীতে সুমুদ আরও বিস্তৃত অর্থ ধারণ করতে থাকে। লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় সামিদিনেরা সশস্ত্র প্রতিরোধ চালান; এ ধরনের সুমুদকে ‘আস-সুমুদুল মুকায়িমু’ বা প্রতিরোধমূলক সুমুদ বলা হয়। ১৯৮৭-৯৩ এবং ২০০০-২০০৫ সালের প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় সুমুদের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়। শুধু সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, স্কুলে বাচ্চা পাঠানো, বাজার করা, তল্লাশিচৌকিতে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ও কারাগারে সহকয়েদিকে উৎসাহ দেয়া—সবই সুমুদ।

প্রবাসী ফিলিস্তিনিদের কাছে সুমুদ সংহতির প্রতীক; এটি ইসরায়েলের দখল, জাতিগত নিধন ও সহায়ক প্রতিষ্ঠানের বর্জন, বিএডিএস আন্দোলন সমর্থন ও কেফিয়াহ রুমাল পরার মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

ফিলিস্তিনিদের জাতীয় জীবনের প্রতীক হিসেবে জলপাইগাছ দেখা হয়। ব্রোঞ্জ যুগ থেকে চাষ হয়ে আসা এই গাছ দীর্ঘকাল বাঁচে, বিপরীত পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকে। ইসরায়েলি দখলের মধ্যে জঙ্গলে নতুন করে জলপাই গাছ রোপণ ফিলিস্তিনিদের জীবনে প্রতিরোধ ও সুমুদের প্রতীক।

ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত মার্কিন চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড ওয়াদি সাইদ লিখেছেন, ‘সন্তান জন্ম দেওয়া, ঘরবাড়ি গড়া, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া এবং লড়াই—সবই সুমুদ’। রামাল্লাভিত্তিক আইনজীবী রাজা শেহাদেহ সৃষ্টিশীল কাজ, সমাজকর্ম ও দৈনন্দিন জীবন পরিচালনাকেও সুমুদ হিসেবে দেখেন।

গাজা অভিমুখী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার মুখপাত্র সাইফ আবুকেশেক বলেন, ‘৭৮ বছর ধরে দখলদারির মধ্যে থাকা ফিলিস্তিনিরা চলমান জাতিগত হত্যার ২২ মাস অতিক্রম করেও নিজেদের ভূমিতে অটল থেকে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের মানসিকতা আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।’

তথ্যসূত্র: মিডল ইস্ট আই, এডওয়ার্ড ওয়াদি সাইদ, রাজা শেহাদেহ, মাহমুদ দারবিশ, বিভিন্ন গবেষণা ও সংকলন।