বিগত কয়েক দিনে চারপাশে যে প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায়—বিসিবি নির্বাচনে কি এমন কিছু আছে, যা মানুষকে আকৃষ্ট করছে—লেখক সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন নির্বাচনপ্রার্থী ও পর্যবেক্ষকদের কথায়।
শিরোনামভিত্তিক প্রশ্নটি গত কয়েক দিনে অনেকেই আমাকে করেছেন। উত্তর তো দিতেই পারিনি; উল্টো আরও অনেক সম্পূরক প্রশ্নও উঁকিঝুঁকি দিয়েছে আমার নিজের মনেই।
সংবাদমাধ্যম আর ফেসবুকে চোখ রাখলে অনেকের মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচনও জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে কম নয়। পরিচালকের ২৫টি চেয়ারের প্রতিটিই এখানে বেশ লাভজনক। নইলে এই এক নির্বাচন নিয়ে এত দলাদলি, এত সমঝোতার নাটক, মামলা-মোকদ্দমা এবং এত চক্ষু লজ্জা বিসর্জন দেওয়া কেন? নিশ্চয়ই বিসিবির সিন্দুকে অমূল্য ধন-রত্ন আছে। কিন্তু মানুষ বুঝতে পারছে না—কী সেই ধন-রত্ন। কী মধু আছে ক্রিকেট বোর্ডে!
বলে রাখা ভালো, বিসিবির পরিচালকদের কোনো মাসিক বেতন বা সম্মানী নেই। শুধু বোর্ড সভায় যোগ দেওয়ার জন্য সম্মানীর ব্যবস্থা থাকে। পরিচালকদের আর্থিক সংগতি বিবেচনায় সেটাও তাদের কাছে খুব বড় কিছু হওয়া উচিত নয়। এছাড়া বছরে একবার এজিএমে যোগ দিলে কিছু উপঢৌকন পাওয়া যায়। সে বন্দোবস্ত সব কাউন্সিলরের জন্যই থাকে। এতটুকুই যদি প্রাপ্তি হয়, তাহলে কিসের আশায় বোর্ড পরিচালক হতে এমন কপাল ঠুকে মরা?
যাঁরা বিসিবি নির্বাচনকে সামনে রেখে কয়েক দিন ধরে কোন্দল-দলাদলি করেছেন, তাদেরই যদি এই প্রশ্ন করা হয়, উত্তর শুনে আপনার মন আনন্দে ভরে যাবে। সাধারণ ক্রিকেট অনুসারীদের মনের প্রশ্নটি আমি গত কয়েক দিনে কয়েকজন পরিচালক প্রার্থীর কাছে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রেখেছি। উদাহরণস্বরূপ দু-চারজনকে জিজ্ঞেস করছি, ‘আচ্ছা, সবাই বিসিবিতে আসতে চাচ্ছে কেন? আগে তো সংগঠক-ক্রিকেটাররা আসতে চাইতেন। এখন দেখি ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন লোকেরাও লাইনে।’
শুনে সম্ভাব্য নির্দেশকের কণ্ঠেও জেঁকে বসে আমারই প্রশ্ন—‘আসলেই তো, সবাই কেন ক্রিকেট বোর্ডে আসতে চায়! আমি বুঝলাম না কী মধু আছে ক্রিকেট বোর্ডে।’ এরপর যদি জানতে চান, ‘আচ্ছা আপনি কেন আসতে চান’, তখন সুর পুরোই বদলে যায়—‘আরে ভাই, ক্রিকেটটাকে তো বাঁচাতে হবে। আমার নিজের অনেক কাজ আছে, ব্যবসা আছে। তারপরও ক্রিকেটের স্বার্থে মাঠে পড়ে থাকি। জীবনটা তো ক্রিকেটের পেছনেই দিয়ে দিলাম।’
এ রকম কেউ যে একেবারেই নেই, তা নয়। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকেও কেউ কেউ ক্রিকেট বোর্ডে থাকতে চান এবং কিছু কাজও করেন। নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো এগোতেই হয়। কিন্তু তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। তাঁদের বাড়তি প্রাপ্তি সামাজিক মর্যাদা—দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থায় থেকে ‘বিসিবি পরিচালক’ পরিচয় রাখা।
তবে ‘আরে ভাই, ক্রিকেটটাকে তো বাঁচাতে হবে...’ জাতীয় কথা শুনলে মনে হয়—এ রকম আরও ১০-১২ জন সংগঠক থাকলে দেশের ক্রিকেটের চেহারাই বদলে যেত। মজার ব্যাপার, এই রকম কথা বলা সংগঠক বাংলাদেশে ১০-১২ জন নয়; খুঁজলে আরও অনেককে দেখা যাবে। কিন্তু তাঁদের নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ায় ক্রিকেটের কতটা উন্নতি হয়েছে, সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো তাদের কাছেও নেই।
ধরা যাক, ক্রিকেটের কাজটা তারা ক্রীড়াসেবামূলকভাবে করছেন। সেখান থেকে তাঁদের কোনো আর্থিক প্রাপ্তি নেই; খেলাটাকে শুধু দেন। তাহলে বলুন, মানসিকতার দিক থেকে যাঁরা নির্লোভ, যারা শুধু দিতেই জানেন, সেসব মানুষেরা সাধারণত কেমন হন? সমাজের নানা ক্ষেত্রে এ রকম মানুষ আছেন—নিজের কাজ নির্বিবাদে করতে চান, কূটচাল-মারপ্যাঁচ তাঁরা বোঝেন না, রাজনীতি আঁচড়াও করেন না। অন্য কেউ একই ভালো কাজ করলে বাধা দেন না; বরং মিলেমিশে করতে প্রস্তুত থাকেন।
কিন্তু ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনে আমরা কী দেখি? এমন মানুষজনও সেখানে আসেন, যারা সংঘাতে লিপ্ত হতে ইচ্ছুক। তারা একে অন্যকে বিব্রত করতে, বিপদে ফেলতে সব সময় ছক কষে। ক্রিকেটের সেবা করার নামে রীতিমতো মারামারি। অথচ তাঁদের সবার দাবি এক—ক্রিকেটের পাশে থাকা।
এটা ঠিক যে বিসিবির পরিচালক পদ মাত্র ২৫টি। চাইলেও এর বেশি লোক বোর্ডে আসতে পারবেন না। শুরুতে প্রায় দ্বিগুণ প্রার্থী ছিল। কিন্তু তাঁরা কেন বোর্ডে এসে ক্রিকেটের সেবা করতে চান, তা বিস্ময়জনক। কারও ক্লাব আছে, কেউ জেলা বা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা থেকে আসছেন, আবার কেউ অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছেন। ক্রিকেটের সেবা তো সেখানেও করা যেত। কয়জন করেছেন তা?
এখানে অনেক নো বল হয়ে গেছে’—বিসিবি সভাপতি হিসেবে আমিনুলের অভিজ্ঞতা এমনটাই। নিজের স্থানে ক্রিকেটের জন্য কিছুই না করে এমন এক জায়গায় এসে তারা সেটা করতে চান, যেখানে আগে থেকেই অনেকে আছেন। ঢুকতে হলে যুদ্ধই লড়তে হয়। গালমন্দ শুনতে ও দিতে হয়। তারপরও বোর্ডে আসতে হবে, ট্যাগ থাকবে ‘বিসিবি পরিচালক’—ক্রিকেটের মধু খেতে হবে।
একটা সময় ছিল, ক্লাব চালাতে বছরে বড় অর্থ খরচ করেই সংগঠকরা ক্লাবের সঙ্গে থাকতেন। বিনিময়ে সেই ক্লাবের কাউন্সিলর হতেন। এখন অনেক ক্ষেত্রেই শুধু অর্থশক্তি দিলেই হয়। তৃতীয় বিভাগীয় একটি দল চালাতে এক মৌসুমে ১৪–১৫ লাখ টাকা লাগে। বিসিবি থেকে অনুদান আসে এক লাখ পাঁচেক। ক্ষমতার জোরে বাকি টাকা দিলেই আপনি কাউন্সিলর হয়ে যেতে পারেন।
বেশ কিছু ক্লাবের ক্ষেত্রে এবার এটাই হয়েছে। যেসব ক্লাবের ক্ষমতাশালী অতিথি কাউন্সিলররা স্বার্থের লড়াইয়ে হেরে সরে গেছেন, সেসব ক্লাবের প্রকৃত সংগঠকেরা চিন্তায় পড়েছেন। ক্ষমতার জোরে টাকা দিয়ে যে অতিথি কাউন্সিলর এসেছিলেন, বোর্ডের মধু না পেয়ে চলে গেলেন—তাহলে ক্লাব চলবে কীভাবে?
ক্রিকেটের মানুষ না-ও হতে পারেন, তবু বিসিবিতে আসার বড় কারণ গ্ল্যামার। একজন পরিচালকও যে পরিমাণ মিডিয়া কাভারেজ পান, তা অনেক মন্ত্রীরও পাওয়া কঠিন। ‘বিসিবি পরিচালক’ পরিচয় ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে একটি বাড়তি যোগ্যতা হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ী হলে তা ব্যবসায়িক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়; রাজনীতিবিদ হলে রাজনৈতিক প্রোফাইলের সঙ্গে নতুন পরিচিতি গঠন করে।
এ ছাড়া বিসিবি পরিচালক হিসেবে বিদেশ ভ্রমণের রেকর্ডও চোখে পড়ে। দলের সঙ্গে এক-দুই পরিচালক নিয়মিতই যেতেন; কখনো প্রয়োজনে। বিদেশে বিজনেস ক্লাসে যাওয়া, পাঁচ তারকা হোটেলে থাকার রেকর্ড আছে। নাজমুল হাসানের সময়ে এমন অভিজ্ঞতা ছিল। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, কিছু পরিচালক দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিলেন—এ বিষয়ে তদন্তও চলছে। তবে অতীত অভিজ্ঞতায় শাস্তি হবে কি না, তাতে সন্দেহ থেকে যায়।
অতীতে দেখা গেছে, একটি পক্ষ বোর্ডে থাকলে আরেক পক্ষ বাইরে থেকে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। ক্ষমতায় আসলে অভিযোগ মৃত প্রতীয়মান হয়; তদন্ত হয় না। এবার দেখা যাক—দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ পায় কি না। নাকি সবকিছু গোপন অস্ত্রেই থেকে যায়। দরকারে ভয় দেখাতে পকেট থেকে বের হবে, পরে আবার ঢুকে যাবে।
মৌচাকে ঢিল মেরে মৌমাছি উড়িয়ে লাভ কী! মৌচাকটা থাকুক। সময়-সুযোগ এলে যার-যার মতো করে মধুটা খেয়ে নিলেই হলো—ইহাই প্রকৃত রাজনীতি ও স্বার্থের রীতি।
পূর্বের পোস্ট :