নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানির ঐতিহাসিক জয় শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, কয়েক হাজার মাইল দূরের ভারতেও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।

বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও বৃহত্তম শহরের মেয়র হিসেবে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি নির্বাচিত হওয়ায় ভারতের রাজনৈতিক মহল ও সংবাদমাধ্যমে এটি উদ্‌যাপনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই আনন্দের পেছনে একটি গভীর রাজনৈতিক প্রতীকও কাজ করছে।

জোহরান মামদানি শুধু ভারতীয় নন, গুজরাটি বংশোদ্ভূতও—যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু পার্থক্য হলো, মামদানি একজন মুসলিম ও বিজেপির কঠোর সমালোচক।

৩৪ বছর বয়সী এই ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য। বিজয় ভাষণে তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘ইতিহাসে খুব কম সময়ে এমন এক মুহূর্ত আসে, যখন আমরা পুরোনো থেকে নতুনের দিকে এগিয়ে যাই... আজ রাতে, নিউইয়র্ক ঠিক সেটাই করেছে।’

বিজয় অনুষ্ঠানে তাঁর স্ত্রী সিরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন রমা দুওয়াজি ও মা-বাবা—চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার ও অধ্যাপক মাহমুদ মামদানিও উপস্থিত ছিলেন।

বিজেপি বনাম মামদানি

মামদানি তাঁর ভারতীয় পরিচয় কখনো লুকাননি। ভারতীয় পোশাক পরা থেকে শুরু করে আঙুল দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ার ছবি—সবই প্রকাশ্যে এনেছেন। তাতে সমালোচনার মুখেও পড়েছেন।

তবে তাঁর বিজয়ের পর বিজেপির শীর্ষ নেতারা নীরব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকেও এখনো কোনো অভিনন্দন বার্তা আসেনি।

মুম্বাইয়ের বিজেপি প্রধান অমিত সাতম মন্তব্য করেছেন, ‘কিছু আন্তর্জাতিক শহরের রং পরিবর্তিত হচ্ছে। যদি কেউ মুম্বাইতে খান বসাতে চান, তা সহ্য করা হবে না।’ তাঁর বক্তব্যকে মুসলিমবিরোধী ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিজেপির সংসদ সদস্য রেখা শর্মা প্রবাসী ভারতীয়দের জোহরানের বিরুদ্ধে ভোট দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন নির্বাচনের আগে।

ভারতের বাস্তবতার প্রতিফলন

ভারতীয় লেখক রানা আইয়ুব বলেন, ‘জোহরান মামদানির বিজয় ভারতের সামনে একটি আয়না—যেখানে হারানো প্রতিশ্রুতি ও বিদ্যমান সম্ভাবনা একসঙ্গে প্রতিফলিত হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ও ২২ কোটি মুসলিমের দেশ ভারতের সংসদে ক্ষমতাসীন জোটে একজন মুসলিম প্রতিনিধিও নেই।’

গুজরাট ও মোদি প্রসঙ্গ

জোহরান মামদানি একাধিকবার মোদির গুজরাট দাঙ্গা ইস্যুতে কড়া মন্তব্য করেছেন। চলতি বছর এক প্রচারণায় তিনি বলেন, ‘মোদি গুজরাটে মুসলিমদের গণহত্যা সংঘটনে সহায়তা করেছিলেন।’

বিজেপি মুখপাত্র সঞ্জু ভার্মা তাঁকে ‘অত্যন্ত মিথ্যাবাদী ও হিন্দুবিদ্বেষী’ বলে আখ্যা দেন। অন্যদিকে, কঙ্গনা রানাউত মন্তব্য করেন, ‘মামদানিকে ভারতীয়ের চেয়ে পাকিস্তানি বেশি মনে হয়।’

বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া

কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী জোহরান মামদানির নেহরু উদ্ধৃতি দেওয়াকে প্রশংসা করে বলেন, ‘নেহরুর নিজ দেশে আজ তাঁকে অপমান করা হচ্ছে, অথচ তাঁর আদর্শ বিদেশে সম্মান পাচ্ছে।’

শশী থারুর ও কৌতুকশিল্পী কুণাল কামরাও মামদানির বিজয়কে ‘ভারতের গর্ব’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

প্রতীকের বিজয়

ভারতে যখন মুসলিমরা ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের মুখে, তখন যুক্তরাষ্ট্রে একজন ভারতীয় মুসলিম নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হওয়া বহু ভারতীয়ের কাছে গর্ব ও বেদনার মিশ্র প্রতীক হয়ে উঠেছে—একদিকে ‘সম্ভাবনার আমেরিকা’, অন্যদিকে ‘হারানো ভারতের’ প্রতিফলন।