রাজশাহী, পাবনা, নাটোর ও কুষ্টিয়াজুড়ে বিস্তৃত পদ্মার চরাঞ্চলে আবারও আতঙ্কের নাম ‘কাকন বাহিনী’। গত সোমবার (২৭ অক্টোবর) দৌলতপুরের দুর্গম চরে এই বাহিনীর গুলিতে দুই কৃষক নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত রয়েছেন আরও দুজন।

নিহতরা হলেন মণ্ডল গ্রুপের আমান মণ্ডল (৩৬) ও নাজমুল মণ্ডল (২৬)। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, একই ঘটনায় কাকন বাহিনীর সদস্য লিটন (৩০) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।

এর আগে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের ইসলামপাড়া এলাকায় গত ১৩ অক্টোবর কাকন বাহিনীর গুলিতে টিনের চালা ও বেড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদিও কেউ নিহত হননি। স্থানীয়রা জানান, বালু মহালের দখল নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা আচমকা গুলি চালিয়ে আতঙ্ক ছড়ান।

বালু ও চাঁদা–নিয়ন্ত্রণে ‘কাকন বাহিনী’

পদ্মা নদীর বালুমহাল ও চরের জমি দখল, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কুখ্যাত ‘কাকন বাহিনী’ চার জেলার মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। স্থানীয়রা বলছেন, বাহিনীপ্রধান রোকনুজ্জামান কাকন ওরফে ‘ইঞ্জিনিয়ার কাকন’ দীর্ঘদিন ধরে বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছেন।

২০০৫ সালে পান্না বাহিনীর নেতা পান্না নিহত হওয়ার পর তাঁর অনুসারী কাকন সৌদি আরব গিয়ে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের আশ্রয়ে বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং নিজের বাহিনী গঠন করেন বলে অভিযোগ।

মামলা হলেও তদন্ত অগ্রগতি নেই

কাকন বাহিনীর বিরুদ্ধে চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ছয়টি মামলা হয়েছে—এর মধ্যে ঈশ্বরদীতে তিনটি, বাঘা, লালপুর ও দৌলতপুর থানায় একটি করে। কিন্তু এখনো কোনো মামলার তদন্ত শেষ হয়নি বলে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ।

ঈশ্বরদী নৌ পুলিশের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘দুটি মামলা আমরা তদন্ত করছি। আসামিদের কেউ এখনো জামিনও নেয়নি।’

চরের মানুষ আতঙ্কে

স্থানীয়রা বলছেন, কাকন বাহিনী এখন পদ্মার চরাঞ্চলে নিয়মিত সশস্ত্র মহড়া দেয়। ড্রোনে ধারণ করা তাদের স্পিডবোট টহলের ভিডিও প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হলেও তেমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

চরের কৃষকরা অভিযোগ করেন, ‘চাঁদা না দিলে ফসল ঘরে তুলতে দেওয়া হয় না।’ কাশবন দখলকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক গোলাগুলির সূত্রপাত ঘটে।

রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আপনারা দেখতে পাবেন, পুলিশ এদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়।’

সেনা-র‍্যাব-পুলিশের অভিযান

১৭ জুলাই সেনাবাহিনী, র‍্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে কাকন বাহিনীর আস্তানায় অভিযান চালায়। অভিযান শেষে ৩টি পিস্তল, ৪৮ রাউন্ড গুলি, মাদকদ্রব্য, মানুষের মাথার খুলি ও নগদ ১২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা উদ্ধার হয়।

ঈশ্বরদী নৌ পুলিশের উপপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অস্ত্র ও মাদকসহ মাথার খুলি উদ্ধার হয়েছে আসামির বাড়ি ও ঘর থেকে।’

নতুন অভিযান

সোমবারের গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) দৌলতপুরের দুর্গম চরে সাঁড়াশি অভিযান চালায় ১২০ সদস্যের পুলিশের বিশেষ দল। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলা অভিযানে কোনো আসামি ধরা না পড়লেও চরবাসীরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।

কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) ফয়সাল মাহমুদ বলেন, ‘দিন ও রাতজুড়ে অভিযান চলবে। শুধু আসামি ধরা নয়, মানুষকে আশ্বস্ত করাই এখন প্রধান লক্ষ্য।’