মোবাইল হ্যান্ডসেটের নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করতে যাচ্ছে সরকার। এই সিদ্ধান্তে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে দেশে আনা ‘গ্রে মার্কেটের’ হ্যান্ডসেট ব্যবসা বড় ধরনের সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিটিআরসির তথ্যানুসারে, দেশে ব্যবহৃত ৬০ শতাংশের বেশি হ্যান্ডসেট গ্রে মার্কেট থেকে আসে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারের ৯০ শতাংশই তাদের নিয়ন্ত্রণে। সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত লাখো ব্যবসায়ীকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি বাজারে হ্যান্ডসেটের দাম বাড়াবে বলেও তারা আশঙ্কা করছেন।
অন্যদিকে সরকারের দাবি, নিবন্ধন প্রক্রিয়া কার্যকর হলে দেশীয় মোবাইল উৎপাদনকারীরা উৎসাহিত হবেন এবং দাম কমবে।
বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর থেকে দেশে ‘ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার’ (এনইআইআর) চালু করবে সরকার। এতে সিমকার্ডের মতো প্রতিটি মোবাইল হ্যান্ডসেটও নিবন্ধনের আওতায় আসবে।
বুধবার (২৯ অক্টোবর) বিটিআরসির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ওইদিনের আগে দেশের নেটওয়ার্কে থাকা সব ফোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধিত হবে। তবে ১৬ ডিসেম্বরের পর নতুনভাবে নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া হ্যান্ডসেটের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হবে। বৈধ হ্যান্ডসেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধিত হবে, কিন্তু অবৈধ হ্যান্ডসেটের নিবন্ধন আর দেওয়া হবে না।
বিটিআরসির হিসাবে, বর্তমানে দেশে প্রচলিত হ্যান্ডসেটের ৬০ শতাংশই অবৈধভাবে আনা। ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, এই হার ৯০ শতাংশের বেশি। একই মডেলের অফিসিয়াল হ্যান্ডসেটের দাম এখন আনঅফিসিয়াল সেটের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ, যা গ্রাহকদের ‘গ্রে মার্কেটের’ দিকে টেনে নিয়েছে।
রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক ও হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজাসহ বড় মার্কেটগুলো এখন অবৈধ হ্যান্ডসেটের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
চোরের সঙ্গে আলোচনা হয় না
আনঅফিসিয়াল’ ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা বহু বছর ধরে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে প্রকাশ্যে ব্যবসা করছেন। মোবাইল বিজনেস কমিউনিটির সভাপতি মো. আসলাম বলেন, “আমরা ট্যাক্স-ভ্যাট দিয়েই বৈধভাবে ব্যবসা করতে চেয়েছি। এখন হঠাৎ করে বলছে, এটা অবৈধ। ১০-১৫ লাখ পরিবার এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।”
তবে বিটিআরসির চেয়ারম্যান এমদাদুল বারী বলেন, “চোরের সঙ্গে আলোচনা করে কখনো আইন হয় না। আমরা ইমপোর্ট বন্ধ করছি না, কেবল অবৈধ আমদানি ঠেকাতে এনইআইআর চালু করছি।”
নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন
মোবাইল খাতবিশেষজ্ঞ রাশেদ মেহেদি বলেন, “দীর্ঘদিনের নিয়ন্ত্রণহীনতায় অবৈধ হ্যান্ডসেট বাজার দখল করে নিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই এই সংকট।”
তিনি মনে করেন, যে হ্যান্ডসেটগুলো ইতোমধ্যে দেশে এসেছে, সেগুলোর বৈধতা পাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।
দাম কমবে না বাড়বে
গ্রে মার্কেট বন্ধ হলে দাম বাড়বে বলে ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা থাকলেও বিটিআরসির চেয়ারম্যানের বক্তব্য, “দেশীয় উৎপাদনকারীদের টেকসই পরিবেশ তৈরি হলে দাম কমবে।”
বর্তমানে দেশে ১৮টির মতো মোবাইল উৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে।
বিটিআরসির মহাপরিচালক আমিনুল হক বলেন, “রিফার্বিশড ও কর ফাঁকি দেওয়া হ্যান্ডসেট বাজারে প্রবেশ করায় বৈধ ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারছেন না।”
রাজস্ব ক্ষতি ও সরকারি অবস্থান
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, অবৈধভাবে হ্যান্ডসেট আমদানির কারণে প্রতিবছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমরা ব্যবসায়ীদের ক্ষতি না করে রূপান্তরের সময় দিচ্ছি। তবে ১৬ ডিসেম্বরের পর গ্রে হ্যান্ডসেট আর চলবে না।”
গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ
হ্যান্ডসেট নিবন্ধনের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে কোনো ফোন বন্ধ করতে পারবে—এতে নাগরিক গোপনীয়তা হুমকির মুখে পড়বে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সাংবাদিক রাশেদ মেহেদি বলেন, “হ্যান্ডসেট বন্ধের ক্ষমতা মানেই নাগরিক প্রাইভেসির ওপর প্রভাব।”
জবাবে ফয়েজ তৈয়্যব বলেন, “এনইআইআর কোনো নজরদারি নয়, এটি অপরাধে ব্যবহৃত অবৈধ হ্যান্ডসেট নিয়ন্ত্রণের জন্য। বিশ্বজুড়ে এই প্রযুক্তি চালু রয়েছে, বাংলাদেশ অনেক দেরিতে শুরু করছে।”
এনইআইআর বাস্তবায়নে সরকার আশাবাদী হলেও ব্যবসায়ীরা ভয় পাচ্ছেন, এতে গ্রে মার্কেট ভেঙে পড়বে, আর হ্যান্ডসেটের দাম বাড়বে। দুই পক্ষের এই টানাপোড়েনের মধ্যে বিজয় দিবসেই শুরু হচ্ছে মোবাইল নিবন্ধনের নতুন যুগ।
পূর্বের পোস্ট :