জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যুক্তরাষ্ট্রে দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেনসহ অন্যদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। নিউইয়র্কের বিমানবন্দরে আখতার হোসেনকে হেনস্তা ও ডিম নিক্ষেপের ঘটনায় এনসিপি এই প্রতিবাদ জানিয়েছে।
মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকার বাংলামোটরে এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এ দাবি জানান।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ও তাঁর সফরসঙ্গীরা স্থানীয় সময় সোমবার বিকেলে নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সফরসঙ্গীদের মধ্যে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় আওয়ামী লীগের একদল নেতা-কর্মীর মুখোমুখি হন। এ সময় আখতার ও তাসনিম জারাকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন স্লোগান দেন ও কটূক্তি করেন। আখতার হোসেনকে হেনস্তা করার একপর্যায়ে তাঁর গায়ে ডিম নিক্ষেপ করা হয়।
বাংলাদেশ সময় সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ বিকেলে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন এনসিপির নেতারা। সেখানে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতাদের দেশ-বিদেশে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। গোপালগঞ্জে জুলাই পদযাত্রায় তাঁদের হত্যার চেষ্টা, উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর বিদেশে হামলার চেষ্টা এবং সর্বশেষ নিউইয়র্কের এয়ারপোর্টের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী তৎপরতার ধারাবাহিকতা। তিনি অভিযোগ করেন, সরকার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ‘প্রশাসনের ভেতরের একটি অংশের মদদেই এসব হামলা ঘটছে। ট্রাইব্যুনালের বাইরে সাধারণ আদালতে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোতে জামিন দেওয়া হচ্ছে। জামিনে আসা আসামিরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে এবং শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের হুমকি দিচ্ছে। দেশে ছোট-বড় পর্যায়ে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা এখন দেশের বাইরেও ঘটছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানোর দায়িত্ব সরকারের। তাদেরকে অপসারণ করে শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।’
সংবাদ সম্মেলনে নিউইয়র্কের কনসাল জেনারেলের পদত্যাগসহ কয়েকটি দাবি জানানো হয়। সেগুলো হলো—যুক্তরাষ্ট্রে আখতার হোসেনের ওপর হামলাকারীদের সবাইকে চিহ্নিত ও অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা, নিউইয়র্কের কনসাল জেনারেলকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে, ঘটনার পূর্ণ তদন্ত করে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, ফ্যাসিবাদের যুগে নিয়োগপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের দোসরদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অপসারণ করতে হবে, উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর হামলাকারী হিসেবে গ্রেপ্তার পাঁচজনের তালিকা প্রকাশ করতে হবে এবং জুলাই গণহত্যার বিচার স্বচ্ছ ও ত্বরান্বিত করতে হবে। এছাড়াও দল হিসেবে সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করার দাবি তোলা হয়।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার শুরু না হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করব এবং সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানাব। ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী অপকর্মের তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে।’
এসময় নাহিদ ইসলাম বলেন, নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিলেও এনসিপির ‘ডায়াসপোরা কমিটি’র কেউ সেখানে ছিলেন না। ‘আমাদের প্রবাসী কমিটির অনেকেই সেখানে ছিলেন, তবে মিসগাইড করা হয়েছিল। তাদের অন্য গেট দিয়ে বের হতে বলা হয়েছিল, যেখানে আমাদের সমর্থকরা ছিলেন না। যারা প্রোটোকল ও নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল, তারাই এই কাজ করেছে। এজন্য আমরা ঘটনার তদন্ত এবং নিরাপত্তা ব্যর্থদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
এক বিদেশি গণমাধ্যমে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্নের জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি যদি আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের রাজনীতি গ্রহণ করে, তবে তা বিএনপির জন্য ক্ষতিকর হবে। আমরা বিএনপিকে গণ-অভ্যুত্থানের অংশীদার ও ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশীদার মনে করি। তাদের ভুল রাজনীতি না করার আহ্বান জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়, কিন্তু বিভিন্ন পক্ষের আক্রমণে আমরা পড়ছি।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘১৫ বছর ধরে যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই করেছেন তাদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা রয়েছে, তবে তাদের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। জনতা কাদের পক্ষে দাঁড়াবে, সেটি ভোটের মাঠ ও রাজপথে বোঝা যাবে। বিএনপিকে আওয়ামী পুনর্বাসনের রাজনীতি থেকে সরে এসে দেশ পুনর্গঠনে অংশ নিতে আহ্বান জানাই।’
আওয়ামী লীগের নির্বাচনে ফেরত আসার সুযোগ নেই বলেও দাবি করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে, কেউ তাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করলে জনগণ তাদের বিরুদ্ধেই দাঁড়াবে। তাদের রাজনীতি বাংলাদেশের মাটিতে অদৃশ্য হয়ে যাবে।’
ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য জোরদারের আহ্বান জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ছাত্রজনতা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, তাদের অপকর্মের বিচার করতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক পক্ষ যেন ঐক্যবদ্ধ থাকে।’
আখতার হোসেনের ওপর হামলার প্রতিবাদে আজ বিকেল ৫টায় শাহবাগে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দিয়েছে এনসিপি। একই সঙ্গে দেশের সব জেলা ও মহানগরে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্তও জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব নাহিদা সারওয়ার নিভা, যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন, যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তরে সংযুক্ত) সালেহ উদ্দিন সিফাত, যুগ্ম সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল-আমিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।