বাংলাদেশে কোনও রাজনৈতিক নেতা এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিল না। আর কোনও রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের জীবনে মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি তার ওপর এত বছর ধরে মণ্ডর করেছিলো না — কিন্তু এই একক দৃশ্য নটিভ চরিত্রে রয়েছে শেখ হাসিনার চোখে।
বাবার উত্তরাধিকারে তিনি সরকারে উঠে আসেন, জনপ্রিয়তা দখল করেন স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের মাধ্যমে, এবং এক সময় ক্ষমতার চূড়ায় পৌঁছান। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক সংগ্রামের নেতা একসময় ক্ষমতাচ্যুত হন রক্তক্ষয়ী “চব্বিশের জুলাই” অভ্যুত্থানে, পালিয়ে ভারতে ফিরে যান।
নিয়মিত শাসন—১২ বছরের বেশি সময়—পরে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে “মানবতাবিরোধী অপরাধ”-এ, এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি হন।
চার মাসের বিচারপ্রক্রিয়ার পর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার বলেন, “স্পষ্ট” প্রমাণ রয়েছে যে শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন এবং তার দলের কর্মীদের হত্যা ও নির্মূল করার “নির্দেশ” দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশে অতীতে রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক রায় থাকলেও কারো মাথায় কখনও মৃত্যু দণ্ড ঝুলেনি। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার ও কারাগারে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কখনও ফাঁসির আসামি করা হয়নি বা বিদেশে পালাতে হয়নি।
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সফর শুরু হয় ছাত্রনেতা হিসেবে—ইডেন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগে সক্রিয় ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর পরিবার বন্দি ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি বিদেশে থাকলেও ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখ্য ব্যক্তিত্ব হন।
তার দীর্ঘ সময় শাসনকালে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি এসেছে, যদিও বিরোধীরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংকুচিত হওয়ার অভিযোগ করেন। ২০০৪ সালের একটি গ্রেনেড হামলায় তাঁর শ্রবণেন্দ্রীয় সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। ডিসেম্বরেই সংবিধান সংশোধনের আলোচনা শুরু হয়, এবং নির্বাচন নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আদালত দেখেছে, তার নির্দেশে ১৪০০ জন হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া মাস্টারমাইন্ড হিসেবে “সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি” ও “জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ” দায়ে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দেওয়া সাবাসী মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আদালত নির্দেশ দেয় তাদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দ করতে এবং নিহতদের পরিবার ও আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ গঠন করতে।
রায় ঘোষণার দিনটি ছিল তাঁর বিবাহবার্ষিকীর দিন — ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
রায়ে পর পরই ভারতে ফিরে তিনি প্রতিক্রিয়া দিয়ে বলেন, “আমাকে সরিয়ে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করার ঘৃণ্য উদ্দেশ্য নিয়ে এ প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে।”
শেখ হাসিনার দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা—ছাত্রনেতা থেকে প্রধানমন্ত্রী, বিদেশনির্বাসন থেকে মৃত্যুদণ্ড—বাংলাদেশের ইতিহাসেই এক অত্যন্ত নাটকীয় অধ্যায় হয়ে রয়ে গেল।
পূর্বের পোস্ট :