আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব কে হচ্ছেন, তা নিয়ে সচিবালয় ও প্রশাসনে আগ্রহ তুঙ্গে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও রয়েছে এ নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল, যেহেতু সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই পদটিরও ভূমিকা রয়েছে। আগামীকাল রোববার কিংবা সোমবারের মধ্যে নতুন জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় এই নিয়োগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এই পদে দক্ষ, যোগ্য ও স্বচ্ছ কাউকে নিয়োগ দিতে হবে, যাতে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন তৈরি না হয়।
এর আগে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োজিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেসুর রহমানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গেল ২১ সেপ্টেম্বর তাঁকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে বদলি করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
নিয়োগের ১৩ মাসের মাথায় মোখলেসুর রহমানকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। এরপর থেকে এই পদটি খালি রয়েছে। বর্তমানে অতিরিক্ত হিসাবে জনপ্রশাসন সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত সচিব ড. আবু শাহীন আসাদুজ্জামান।
ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে তৎকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন তাঁর পরিবর্তে মোখলেসুর রহমানকে দুই বছরের জন্য চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
নির্বাচনের সময় সরকারি কর্মকর্তাদের পদায়ন ও রদবদলে জনপ্রশাসন সচিবের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এতে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তাদের পছন্দের কর্মকর্তাকে এই পদে বসাতে চেষ্টা করছেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। আবার কোনো কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিজেরাও তদবির করছেন ওই পদটিতে বসার জন্য।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিতে নয় দিনের নিউইয়র্ক সফর শেষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার দেশে ফিরেছেন। তিনি ঢাকা ছাড়েন ২২ সেপ্টেম্বর। মূলত এ কারণেই জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগে বিলম্ব হয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এ পদে নিয়োগ নিয়ে এখন পর্যন্ত পাঁচ থেকে ছয়জন কর্মকর্তার নাম আলোচনায় আছে। তাঁদের বেশির ভাগই চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, জনপ্রশাসন সচিব হওয়ার দৌড়ে আলোচনায় রয়েছেন বেশ কয়েকজন; তাঁদের মধ্যে ভূমি সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদের নামই বেশি শোনা যাচ্ছে। খালেদা জিয়া বিরোধী দলীয় নেতা থাকাকালে তাঁর একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব হন সালেহ আহমেদ।
একই পদে থেকে ২০২০ সালে অবসরে যান প্রশাসন ক্যাডারের সপ্তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা। গত বছরের ২ অক্টোবর দুই বছরের চুক্তিতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে।
এছাড়া এই পদটিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলামেরও নাম শোনা যাচ্ছে। গেল ২৭ মার্চ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একাদশ ব্যাচের এই কর্মকর্তাকে। দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
জনপ্রশাসন সচিব হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণিও নিয়োগ পেতে পারেন। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিসিএস ১৯৮২ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা তিনি। ২০০১ সালে তিনি উপসচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং জামালপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পান।
২০০৯ সালে তাঁকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। চার বছর ওএসডি থাকার পর ২০১৩ সালে তাঁকে চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়।
এছাড়াও আলোচনায় রয়েছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব রেজাউল মাকসুদ জাহেদী। গত ৭ এপ্রিল স্থানীয় সরকার বিভাগে সচিব হিসেবে যোগ দেন তিনি। এর আগে তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিসিএস প্রশাসন সার্ভিসের সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৯৪ সালে সহকারী কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন।
জনপ্রশাসন সচিব হিসেবে এমন কাউকে নিয়োগ দেওয়া উচিত, যিনি সততা ও যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন বলে মন্তব্য করেন সাবেক সচিব একে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার।
শনিবার (৪ অক্টোবর) তিনি বলেন, এই পদে এমন একজন পেশাদার আমলাকে নিয়োগ দেওয়া উচিত, যিনি পুরো প্রশাসনকে অল্প সময়ের মধ্যে গুছিয়ে আনতে পারবেন। সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে রাজনীতির সরাসরি কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। একজন সিভিল সার্ভেন্ট মানেই হচ্ছেন অরাজনৈতিক। সারা বিশ্বজুড়েই এই চর্চা হয়ে আসছে।
সাবেক এই আমলা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রেও রাজনৈতিকভাবেও কোনো সিভিল সার্ভেন্ট নিয়োগ পেলে তার আর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকে না। তখন তিনি সরকারের জন্য কাজ করেন। আর আমাদের দেশে তো সবাই ক্যারিয়ার সিভিল সার্ভেন্ট। আমাদের দেশে রাজনৈতিক নিয়োগ কম। কাজেই আমাদের দেশের সিভিল সার্ভিসে রাজনৈতিক চিন্তা মাথায় আসারই কোনো কারণ নেই। যদিও আসে, সেটা ভুল হবে।
‘কাজেই নতুন যিনি জনপ্রশাসন সচিব হবেন, আমরা ধরে নেব–তিনি হবেন পেশাদার, নিরপেক্ষ, এবং সিভিল সার্ভিসের যেসব বৈশিষ্ট্য আছে, সেসবের আঙ্গিকে জনপ্রশাসনকে সাজাবেন—তাঁর কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকবে না,’ যোগ করেন আবদুল আউয়াল মজুমদার।
তিনি বলেন, আমরা যদি একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশা করি, তাহলে আমাদের জনপ্রশাসনও হতে হবে তেমনই। নতুন জনপ্রশাসন সচিব যিনি হবেন, তিনি এমন লোকদেরই বাছাই করে পদায়ন করবেন, যারা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে নির্বাচনটি করবেন, যারা কোনো দলের হবে না।
নিজের মন্ত্রণালয়কে গোছানোই হবে জনপ্রশাসন সচিবের কাজ মন্তব্য করে সাবেক এই আমলা আরও বলেন, তাকে অভ্যন্তরীণভাবে মন্ত্রণালয়কে ভালোভাবে চালাতে হবে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)সহ মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে সৎ ও যোগ্য লোকদের পদায়ন করতে হবে। সরকারকে সেভাবেই পরামর্শ দেবেন। যারা কোনো দলের পক্ষপাত না হয়ে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনটি বের করে নিয়ে আসতে পারবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, জনপ্রশাসন এমনিতেই অনেক খারাপ অবস্থায় আছে। এত দুর্বল প্রশাসন আর কখনো দেখা যায়নি। এখনো যদি জনপ্রশাসনকে থিমকতে সাজাতে না পারে, তাহলে তাদের পক্ষে একটি ভালো নির্বাচন করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এমনিতেই বিলম্ব হয়ে গেছে, আরও বিলম্ব হলে ভালো নির্বাচনের আশা করা যায় না। নিরপেক্ষ, দক্ষ ও যোগ্য লোককে এই মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো দেখে, অন্য দলের কাউকে ওখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তখন বাকি দলগুলো তা মেনে নেবে না। প্রথম থেকেই সরকার নিরপেক্ষ লোকজনকে নিয়োগ দেয়নি, এখন সেই সমস্যাটা আরও প্রকট হয়েছে।
পূর্বের পোস্ট :