রূপে, গুণে, ঘ্রাণে, স্বাদে জাতীয় মাছ ইলিশ বাঙালির পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকলেও দুর্মূল্যের বাজারে একসময়ের প্রতি সপ্তাহে পাতে থাকা মাছ হয়ে উঠেছে মাসে একবার খাওয়া যায় এমন শখের খাদ্যপণ্য; এক বছরে ইলিশের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।
অক্টোবরের ৪ তারিখ থেকে ২২ দিন দেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ঘোষণার পরপরই বাজারে ইলিশের দাম বেড়েছে কেজিতে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা।
রাজধানীর বিভিন্ন মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, ইলিশের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দাম আগের তুলনায় অনেক বেশি। ২৫০ থেকে ৪৫০ গ্রামের জাটকা ইলিশ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৮০০ টাকায়, ৫০০ থেকে ৭৫০ গ্রামের ইলিশ ১২০০ টাকা, ৭৫০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ ১৬০০ থেকে ২০০০ টাকা এবং এক কেজির ওপরে বড় ইলিশ কেজিপ্রতি ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক সমীক্ষায় আগস্টের দেওয়া ইলিশের দামের সঙ্গে সেপ্টেম্বরের দামের তুলনা করে দেখা গেছে, প্রতি কেজিতে ইলিশের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। এক কেজির বেশি ওজনের ক্ষেত্রে এ দামের তারতম্য অনেক ক্ষেত্রে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা।
‘কয়েক দিনের মধ্যে ইলিশ ধরা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে, তাই ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ইলিশ কিনতে। এতে করে আপনা–আপনিই মাছের দাম বেড়ে গেছে,’ বলেন শান্তিনগর কাঁচাবাজারের মাছ বিক্রেতা এনামুল।
কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা শহীদ জানান, পাইকারিতে ইলিশের দাম বেড়ে যাওয়ায় শহরের বাজারে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে সংকট নেই।
ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্টে দেড় কেজি ওজনের বড় ইলিশ কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ২০০০ টাকায় বিক্রি হলেও ২০২৫ সালে একই সাইজের ইলিশের দাম দাঁড়িয়েছে ৩০০০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বাজারে ইলিশের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।
‘এক দশক আগেও ইলিশ হালি কিংবা জোড়ায় বিক্রি হতো। এক হালি বড় ইলিশের দাম পড়ত ২০০০ টাকার কম। এখন একটি বড় ইলিশ কিনতে গেলে খরচ হয় ৫০০০ টাকা,’ আক্ষেপ করে বলেন ইলিশ কিনতে আসা ক্রেতা মুহিবুর রহমান।
ক্রেতারা জানান, আগে যেখানে প্রতি সপ্তাহে ইলিশ খাওয়ার সামর্থ্য ছিল, এখন মাসে একবার ইলিশ কিনে খাওয়ার সামর্থ্যও থাকে না তাঁদের। পছন্দের এই মাছ বাদ দিয়ে অন্য মাছে মেটাতে হয় আমিষের চাহিদা।
তবে ইলিশের দাম হু হু করে বাড়লেও এর সুফল মেলেনি জেলেদের জীবনে। দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ পাওয়া যায় ভোলা জেলায়। এখানকার বেশির ভাগ জেলের নিজস্ব কোনো নৌকা নেই। আড়তের মহাজনের নৌকা এবং দাদন নিয়ে মাছ ধরেন তাঁরা। ফিরে এসে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন দরে ওই মহাজন বা তাঁদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্যবসায়ীর কাছে মাছ বিক্রি করতে হয়।
‘নৌকা আর অগ্রিম টাকা দেয় মহাজন। মাছ ধরে এনে বিক্রি করে যা পাই, সেই টাকা দিয়ে দাদন শোধ করি। যা থাকে, তাই লাভ। কিন্তু লাভ তেমন কিছুই থাকে না,’ বলেন প্রবীণ জেলে খালেক মাঝি।
ভোলা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, নোয়াখালীতে জেলেদের ধরা ইলিশ ওঠে মাছঘাটে। বরিশালের সর্ববৃহৎ পোর্ট রোড মাছঘাটে ভোর হওয়ার আগেই পৌঁছে যায় ট্রলার। সেখান থেকে আড়তে ওঠানো হয় ইলিশ। পরে হয় নিলাম। পাইকাররা মাছ কিনে নিয়ে যান বড় বাজারে। সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতাদের হাতে এসে ভোক্তার কাছে পৌঁছায় মাছ। এভাবে পাঁচ ধাপ পার হয়ে পৌঁছায় ইলিশ।
ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে, এই পাঁচ ধাপে বাড়তে থাকে মাছের দাম। জেলে হয়তো দেড় কেজি ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি ১০০০ টাকায় বিক্রি করেন, কিন্তু ঢাকায় সেই মাছ কিনতে হয় ৩০০০ টাকায়। হাতবদলের কারণে স্বাভাবিকভাবে মাছের দাম বেড়ে যায় ৬০ শতাংশের বেশি।
কমিশনের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, জেলেদের মাছ ধরতে কেজিপ্রতি খরচ হয় ৪৭০ থেকে ৫০০ টাকা। তবে এতগুলো হাতবদল আর মুনাফার নির্দিষ্ট সীমা না থাকায় ৫০০ টাকার মাছের ওপর লাভ চলে যায় ক্ষেত্রবিশেষে হাজার টাকা পর্যন্ত। পাইকার থেকে খুচরা ব্যবসায়ীর হাতে মাছ আসতে খরচ বাড়ে কেজিপ্রতি ৭৫ টাকা, খুচরা থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে বাড়ে প্রায় ১৫০ টাকা। এর ওপর যুক্ত হয় আড়তের কমিশন, দাদনের চাপ আর সিন্ডিকেটের কারসাজি।
‘সিন্ডিকেট ছাড়া শুধু হাতবদলের চক্রেই মাছের দাম বেড়ে যায় ৫০ শতাংশের ওপরে। এরপর আছে সিন্ডিকেটের কারসাজি। তারা মাছ ধরে কোল্ড স্টোরেজে মজুত করে। এদিকে দাদনের কমিশন অনেক সময় ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়,’ বলেন জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচারের পিএইচডি গবেষক, কৃষি অর্থনীতিবিদ সাব্বির হোসেন খান।
ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ, এত হাতবদলের চক্র বাদ দিয়ে সরাসরি জেলেদের সমবায় সমিতি কিংবা মৌসুমি সরকারি বিপণন কেন্দ্রের মাধ্যমে বাজারে ইলিশ সরবরাহ করা। এতে দাম কমবে, জেলেরা পাবেন ন্যায্য মূল্য, আর ভোক্তারাও কিনতে পারবেন সাশ্রয়ী দামে।
পূর্বের পোস্ট :