দশ দিনের ব্যবধানে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে দ্বিগুণ; দৈনিক বাড়তি দামে পেঁয়াজ কিনে ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাব অনুযায়ী, দেশে দৈনিক ভোক্তাকেন্দ্রিক পেঁয়াজের চাহিদা ৭ হাজার মেট্রিক টন।
এই চাহিদার ওপর ভিত্তি করে দাম হিসাব করলে দশ দিনে এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৬০-৭০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১১০-১২০ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা। সে হিসাবে ৭ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে ভোক্তার পকেট থেকে দৈনিক অতিরিক্ত ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে।
পেঁয়াজ নিয়ে সরকার রীতিমতো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ক্রান্তিকালে এসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে আমদানির কথা। এদিকে প্রতিদিন ভোক্তার পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা নাই হয়ে যাচ্ছে,” বলেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং ক্যাব সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।
রবিবার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশীরউদ্দিন জানান, এই সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের দাম না কমলে আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে। তবে আমদানির অনুমতি দিলে কৃষক ক্ষতির মুখে পড়বেন।
একদিকে ভোক্তার পকেট থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে, অন্যদিকে আমদানির অনুমতি দিলে ডিসেম্বরে মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজ চাষিরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন—এ অবস্থায় সরকারের করণীয় প্রসঙ্গে সফিক জানান, আমদানির অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে। দাম বেড়ে যাওয়ার পর আমদানির অনুমতি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে করতে ভোক্তা বিপদে পড়ছেন।
সেপ্টেম্বর থেকে সীমিত পরিমাণে আমদানি করলে এখন এসে পেঁয়াজের সংকট হতো না। এখন এসে সরবরাহ সংকটের দোহাই দিয়ে একদল টাউট-বাটপার কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে আর বাণিজ্য উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলছেন সিন্ডিকেট খুঁজে বের করতে, তাহলে মন্ত্রণালয় কী করছে?” প্রশ্ন রাখেন সফিক।
ক্যাব সভাপতি জানান, কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে এ বছর ৩৫ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে—কিন্তু এই তথ্য মোটেই বিশ্বাসযোগ্য না। কৃষকের হাতে এখন পেঁয়াজ নেই, একইভাবে সীমিত পেঁয়াজ আছে আড়তদারদের হাতে। এ অবস্থায় পেঁয়াজ আমদানি ছাড়া কোনো উপায় নেই।
বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতির সুপারিশ করে বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। কমিশন বলছে, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজির কারণে বাজারে পেঁয়াজের দাম লাগামহীন।
স্থানীয় বাজারমূল্য বিবেচনায় দেখা যায়, গত দুই-তিন মাসে পেঁয়াজের মূল্য স্থিতিশীল থাকলেও গত এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে ৩৭ থেকে ৪২ শতাংশ। প্রতিবছর অক্টোবর-ডিসেম্বরে দাম বাড়ার প্রবণতা থাকলেও গত সপ্তাহে দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে, যা বাজার ব্যবস্থাপনা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজির সরাসরি ইঙ্গিত দেয় বলে কমিশনের তথ্যে উঠে এসেছে।
আগে রাজনৈতিক সরকার ছিল, সিন্ডিকেটে তাদের একটা সুবিধা ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন কেন সিন্ডিকেট রুখতে পারছে না, এ ব্যাপারটি বোধগম্য না। এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, যেখানে কৃষকের ক্ষতি না করে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা সম্ভব না,” বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং কৃষি অর্থনীতিবিদ আবদুল বায়েস।
তিনি জানান, কৃষিতে সিন্ডিকেট এবং করপোরেট অলিগার্কি বন্ধ করতে না পারলে এ ধরনের দোটানা সব সময়ই সৃষ্টি হবে এবং এমন দোটানাকে কাজে লাগিয়ে লাভ করবে অসাধু গোষ্ঠী।
বিটিটিসির তথ্যানুযায়ী, দেশের অধিকাংশ পেঁয়াজ আমদানি হয় ভারত থেকে। ভারতে পেঁয়াজের দাম এখন কেজিতে প্রায় ১৬ টাকা, অর্থাৎ টনে ১৯৫ ডলার। সেই হিসাবে ১০ শতাংশ শুল্ককর বহাল রেখেও পেঁয়াজ আমদানি করা গেলে দেশে কেজিপ্রতি ৫০ টাকার কম দামে বিক্রি করা সম্ভব।
কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, আগামী সপ্তাহের মধ্যে ৭৫ হাজার টন নতুন দেশীয় পেঁয়াজ আসবে। ডিসেম্বরের শুরুতেই আসবে মুড়িকাটা পেঁয়াজ। এ অবস্থায় চলতি সপ্তাহে দাম না কমলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানে না কৃষি মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আমরা জানিয়েছি, দুই সপ্তাহের মধ্যেই বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসবে। আমদানি নিয়ে কোনো বক্তব্য বা সিদ্ধান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বা সচিব নিয়েছেন কি না, সে ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু জানে না,” বলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুর রহমান।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের দেওয়া পেঁয়াজের বাজারদর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিবছর মার্চে পেঁয়াজের দামের তুলনায় নভেম্বরে দাম বাড়ে ১০০ শতাংশের বেশি। এ সময় কৃষকের হাতে পেঁয়াজ না থাকায় সুযোগ নেয় কারসাজিকারকেরা।
এই সময়ে দাম বৃদ্ধি নতুন কিছু না। অথচ প্রতিবার একই ঘটনা ঘটে। কয়েক শ কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায়। এরপর আমদানি করা শুরু হয়। এমন সময়ে আমদানি করা শুরু হয়, যখন বিপদে পড়েন কৃষক,” বলেন বায়েস।
জেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ির মতো জেলায় কৃষকেরা মুড়িকাটা পেঁয়াজ রোপণ করেছেন। আকারে ছোট এই পেঁয়াজ উৎপাদনে মণপ্রতি খরচ হয় ১ হাজার ৫০০ টাকার মতো।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের কৃষক রোকনুজ্জামান বলেন, “গত বছর মুড়িকাটা চাষ করে লোকসান হয়েছিল। এখন বাজারে পেঁয়াজ প্রতিমণ ৩ হাজার ৫০০ টাকার ওপরে। মুড়িকাটার সময়ে বাজারে ভারতের পেঁয়াজ আসলে মণপ্রতি পেঁয়াজের দাম কমে হয় ১ হাজার ২০০–১ হাজার ৪০০ টাকা। তখন লোকসান দিয়ে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হয়।”
কৃষকেরা জানান, এবার মণপ্রতি মুড়িকাটার দাম ২ হাজার টাকার কম হলে লোকসানে পড়বেন তারা। একদিকে ভোক্তার নাভিশ্বাস, অন্যদিকে কৃষকের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শিতাকেই দায়ী করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
পূর্বের পোস্ট :