বাজারে লাগামহীন পেঁয়াজের দাম, এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৭০ টাকার পেঁয়াজ এখন ১২০ টাকা।

শুক্রবার ঢাকার পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত শুক্রবারের তুলনায় এই শুক্রবারে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৪০–৫০ টাকা। খুচরা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০–১২০ টাকায়।

বাড়তি দাম পাইকারি বাজারেও। প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) পেঁয়াজ ২৬০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫২০ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো দোকানে পেঁয়াজের পাল্লাপ্রতি দাম পড়ছে ৫৩০–৫৪০ টাকা পর্যন্ত। এতে করে পাইকারি দরেও পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকার ওপরে।

উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী শরিফুল বলেন, দুই–তিন দিনের ব্যবধানে প্রতি বস্তায় কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২৬–২৮ টাকা করে। এজন্য বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে তাঁদের।

আরেক পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আমিনুল বলেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের সরবরাহ কম। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকেই পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে, যা এখনো চলমান।

দাম বাড়ায় হতাশ ক্রেতারা। জানান, রাতারাতি যেভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে তাতে করে শঙ্কিত তাঁরা।

‘তিন দিন আগেও পেঁয়াজের কেজি ছিল ৮০ টাকা। এখন ১০০ টাকার ওপরে। হুট করে কোন যুক্তিতে এভাবে দাম বাড়ে,’ ক্ষোভ প্রকাশ করেন কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা ক্রেতা ফাহমিদুল।

আড়তদাররা জানান, মণপ্রতি পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। মধ্যস্বত্বভোগী একটি শ্রেণি পেঁয়াজ মজুত করে এখন বাড়তি দামে ছাড়ছে বলে অভিযোগ করেন তাঁরা।

উত্তর বাড্ডার পেঁয়াজ আড়তদার সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম গত সপ্তাহেই দ্বিগুণ হয়েছে। আমরা ৪০০০ টাকা মণে পর্যন্ত পেঁয়াজ কিনেছি। সেই পেঁয়াজ বাজারে ছাড়ায় হঠাৎ করে দাম বেড়ে গেছে।’

হঠাৎ করে বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়লেও যথেষ্ট মনিটরিং নেই বলে দাবি ভোক্তাদের। আরেক ক্রেতা মায়মুনা আক্তার বলেন, ‘সব সময় শুনি বিক্রেতার দোষ নেই। আবার শুনি কৃষক ন্যায্যমূল্য পায় না। লাভের গুড় কারা খায় এটা বের করা সরকারের দায়িত্ব, কিন্তু কখনোই এ ব্যাপারে সুবিধা করতে পারেন না তাঁরা।’

জেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আসে পাবনা, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী থেকে। এই তিন জেলাতেও পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি প্রায় ১০০ টাকা।

হঠাৎ করে দেশে পেঁয়াজের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে কেন— জানতে চাইলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানান, এই দরবৃদ্ধি আকস্মিক নয়। বছরের অক্টোবরের শেষ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম বাড়তি থাকে।

কৃষকের হাতে কোনো পেঁয়াজ নেই। পেঁয়াজ এখন আড়তদারদের হাতে। মজুত পেঁয়াজ দিয়ে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। বাজারে যত দিন না নতুন পেঁয়াজ উঠবে, তত দিন দাম অস্বাভাবিক থাকবে,’ বলেন তিনি।

এছাড়া আমদানি বন্ধ এবং এ সময়ে ভারতেও পেঁয়াজের দাম বেশি থাকায় হিলি বন্দরে চাপ সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব দেশের বাজারে পড়ে বলে জানান তিনি।

কবে নাগাদ বাজার স্বাভাবিক হতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল জানান, কৃষকরা নতুন জাতের পেঁয়াজ রোপণ করেছেন। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে বা মাঝামাঝি সময়ে এই পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করলেই দাম কমবে।

‘বাজারে হালি পেঁয়াজ নেই, মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ শুরু করেছেন কৃষকরা। অক্টোবরে এই পেঁয়াজের আবাদ শুরু হয়। ফলন ওঠে ডিসেম্বরে,’ বলেন তিনি।

এদিকে মুড়িকাটা পেঁয়াজ নিয়ে হতাশ কৃষকরা। পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার কৃষক আরশাদ মোল্লা জানান, গত বছর মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ করে লোকসানে পড়েছেন তাঁরা। প্রতি মণে ৫০০–১০০০ টাকাই লোকসান হয়েছে। এখন পেঁয়াজের মণ ৩০০০ টাকার ওপরে হলেও ডিসেম্বরে নতুন পেঁয়াজ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দাম নেমে যায় ২০০০ টাকার নিচে।

‘অনেক কৃষক এবার মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ করেননি। এর মধ্যে বৃষ্টি থাকায় যারা আবাদ করেছেন, তারাও দেরিতে শুরু করেছেন পেঁয়াজ রোপণ,’ বলেন তিনি।

তবে দেরিতে আবাদ হলেও বাজারে এর বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ওবায়দুর জানান, সর্বোচ্চ ৪–৫ দিনের একটি ব্যবধান হতে পারে আগের বছরের তুলনায় বাজারে নতুন পেঁয়াজ উঠতে।

‘মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ শুরুই হয় হালকা শীতের সময়। এই পেঁয়াজ উঁচু জমিতে লাগাতে হয়। পানি জমে পেঁয়াজ নষ্টের সম্ভাবনা নেই। বাজারে উঠতে হয়তো সামান্য দেরি হবে,’ বলেন তিনি।

যদিও ব্যবসায়ীদের একাংশের দাবি, আমদানি বন্ধ থাকায় পেঁয়াজের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাজার যাচাই–বাছাই করে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে দুই সপ্তাহের মধ্যে বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসবে। যদি তাই হয়, তাহলে হয়তো আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।

‘প্রতি বছর এমনিতেও ৫–৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হলেও এর ২৫ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমদানির প্রয়োজন পড়ে,’ বলেন তিনি।

তবে পেঁয়াজের এই দরবৃদ্ধি সংকটকেন্দ্রিক বলে মনে করে না ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

ক্যাবের সহসভাপতি নাজের হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে একটি গোষ্ঠী। এটি নিঃসন্দেহে কৃত্রিম সংকট। বাজার কারসাজি বন্ধ করলে আপনা থেকেই পেঁয়াজের দাম কমে যাবে।’

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে পেঁয়াজের দাম এক মাসে বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। যদিও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বর্তমানে পেঁয়াজের দাম কম, তবুও বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দাম কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছেন ভোক্তা সংশ্লিষ্টরা।