জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দেওয়ার পর সেই মতপার্থক্য নতুন করে তীব্র হয়েছে।

কমিশনের সুপারিশে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানালেও বিএনপি তীব্র সমালোচনা করেছে। এতে করে শেষ সময়ে এসে দলগুলোর মধ্যে নতুন বিভাজন তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

বিএনপির প্রতিক্রিয়া

বুধবার (২৯ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংস্কারের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত না হলে এর দায়ভার তাকেই নিতে হবে।’

তিনি অভিযোগ করেন, কমিশন বিএনপির দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ উপেক্ষা করেছে। তাঁর ভাষায়, ‘যে বিষয়গুলোতে আমরা একমত ছিলাম না, সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু সুপারিশে সেগুলোর কোনো উল্লেখ নেই। এটা জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা।’

দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও (মঙ্গলবার) এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। নেতারা মনে করেন, কমিশনের প্রস্তাব জাতিতে ঐকমত্য নয়, বরং বিভক্তি সৃষ্টি করবে।

তিন ইস্যুতে মুখোমুখি তিন দল

সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশে গণভোটের সময়, ভিন্নমতের অনুল্লেখ এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ—এই তিন বিষয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির অবস্থান স্পষ্টভাবে আলাদা হয়ে গেছে।

জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘ভিন্নমত সিদ্ধান্তের ভিত্তি হতে পারে না। সিদ্ধান্ত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে—এটাই বিশ্বব্যাপী প্রথা। কমিশনের সুপারিশে সেই নিয়মই অনুসরণ করা হয়েছে।’

দলগুলোর অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের কর্মপরিধিতে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ ছিল না। তবে জামায়াত ও এনসিপির দাবিতে কমিশন ৩১ জুলাইয়ের পর দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে উপায় নির্ধারণ করে। ৯ অক্টোবর আলোচনা শেষ হয়। সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে ঐকমত্য হলেও সময় ও পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত থেকেই যায়।

বিএনপি চায়, জুলাই সনদকে ভিত্তি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে গণভোট হোক জাতীয় নির্বাচনের দিনেই। এতে নির্বাচিত সংসদের জন্য আলাদা ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।

অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি চায়, জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট হোক। তাদের প্রস্তাব, সরকার ‘জুলাই বাস্তবায়ন আদেশ’ জারি করে সনদের ভিত্তিতে গণভোটের আয়োজন করবে এবং ফলাফলের ভিত্তিতেই সংস্কার কার্যকর হবে।

অন্যান্য প্রতিক্রিয়া

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সুপারিশে নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখ নেই। এটা ঐকমত্য নয়। কমিশন এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবে বলে আশা করছি।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘কমিশনের সুপারিশে জুলাই সনদের পূর্ণ প্রতিফলন নেই। এতে ঐক্যের বদলে বিভাজন তৈরি হচ্ছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, কিছু রাজনৈতিক দলের প্রস্তাব জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

অন্যদিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গণভোটের তারিখ দ্রুত ঘোষণার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘গণভোটে দেরি হলে জাতীয় নির্বাচন সংকটে পড়বে।’

জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘সংবিধানবহির্ভূত নয় এমন সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। প্রস্তাব–১ বাস্তবায়নের পথে সরকারকে অগ্রসর হতে হবে।’

পরবর্তী কর্মসূচি

জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দল ৩ নভেম্বর বৈঠকে বসবে বলে জানা গেছে। সেখানে পাঁচ দফা অভিন্ন দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।