দুই বছর আগেও টেকনাফ থেকে জাহাজে করে সহজেই দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন যাওয়া যেত। এতে পর্যটকদের সময় ও অর্থ দুই-ই সাশ্রয় হতো। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র তৎপরতা বাড়ার পর নৌপথকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে প্রশাসন সেই রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়।
এরপর থেকে সেন্ট মার্টিনগামী জাহাজগুলো যাতায়াত করছে কক্সবাজার থেকে। তবে জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে এসব জাহাজ চালানো হয়। সকাল ৯টায় যাত্রা শুরু করলে সেন্ট মার্টিনে পৌঁছাতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা সময় লাগে। অর্থাৎ বিকেল গড়িয়ে তবেই পৌঁছায় জাহাজগুলো।
কিন্তু সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, নভেম্বরে সেন্ট মার্টিনে গেলে সেদিনই ফিরে আসতে হবে। এতে পর্যটকরা দ্বীপে থাকতে পারবেন সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা।
সেন্ট মার্টিন হোসাইন জুহুরা ফাউন্ডেশনের সভাপতি আব্দুর রহিম জিহাদীর ভাষায়, ‘জেটি ভাঙা থাকায় জাহাজ থেকে দ্বীপে নামতেই এক ঘণ্টা লেগে যাবে। তাহলে হাতে থাকবে আর এক ঘণ্টা। ১৪-১৫ ঘণ্টা সমুদ্রে ভেসে এই এক ঘণ্টার জন্য কে আসবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে রাত্রিযাপনের অনুমতি থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ও রমজান আছে। ফলে ভালো পর্যটক আসবে না। এই এক মাসের আয় দিয়ে দ্বীপবাসীর ১১ মাস চলে না।’
সরকারের নির্দেশনা
পরিবেশ মন্ত্রণালয় বুধবার (২৩ অক্টোবর) এক প্রজ্ঞাপনে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটন নিয়ন্ত্রণে ১২টি নির্দেশনা জারি করেছে।
এতে বলা হয়েছে—
নভেম্বরে শুধুমাত্র দিনের বেলায় ভ্রমণ করা যাবে, রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ।
ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে রাত্রিযাপনের অনুমতি থাকবে, ফেব্রুয়ারিতে পর্যটন পুরোপুরি বন্ধ থাকবে।
প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক দ্বীপে যেতে পারবেন।
বিআইডব্লিউটিএ পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো নৌযান চালাতে পারবে না।
অনলাইনে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েবসাইট থেকে টিকিট কিনতে হবে, কিউআর কোড ছাড়া টিকিট বাতিল বলে গণ্য হবে।
সৈকতে আলো, শব্দ বা বারবিকিউ পার্টি নিষিদ্ধ থাকবে।
কেয়া বন, কাছিম, প্রবাল ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা বাধ্যতামূলক।
মোটরচালিত যান চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বহন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
দুর্দশায় দ্বীপবাসী
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেন্ট মার্টিন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কঠোর বিধিনিষেধ জারি হচ্ছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দা।
দ্বীপের ৭০ শতাংশ মানুষ পর্যটননির্ভর। বাকি দেড় হাজার পরিবার মাছ শিকারে যুক্ত। দুই পেশাই এখন বিপর্যস্ত।
ইউপি সদস্য ছৈয়দ আলম বলেন, ‘কমপক্ষে ২০০ পরিবার কাজের সন্ধানে দ্বীপ ছেড়েছে। অনেকে কক্সবাজার বা টেকনাফে গিয়ে ইজিবাইক বা ভ্যান চালাচ্ছে।’
স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী হাফেজ আবুল হোসেন বলেন, ‘অভাবের তাড়নায় কেউ স্ত্রীর গয়না বিক্রি করছেন, কেউ দ্বীপ ছেড়ে যাচ্ছেন। বিকল্প কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি থাকলেও কোনো উদ্যোগ নেই।’
জেলেদের ভয় আরাকান আর্মি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাত বাড়ায় সাগরে নামতেও ভয় পাচ্ছেন সেন্ট মার্টিনের জেলেরা। ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আজিম বলেন, ‘আমরা যেখানে মাছ শিকার করতাম, সেখানে গেলে আরাকান আর্মি ট্রলারসহ ধরে নিয়ে যায়। ফলে জেলেদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।’
অপেক্ষায় জেটি সংস্কার
দ্বীপে পর্যটকদের ওঠানামার একমাত্র জেটির সংস্কারকাজ এখনো শেষ হয়নি। ফলে আসন্ন মৌসুমে জাহাজ ভেড়ানোর জায়গা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এস এস রহমান ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি আলী হায়দার বলেন, ‘বৈরী আবহাওয়ায় কিছুটা দেরি হলেও মৌসুম শুরুর আগে কাজ শেষের চেষ্টা চলছে।’
রিসোর্টে নেমে গেছে প্রস্তুতির আমেজ
অক্টোবরে সাধারণত দ্বীপে হোটেল-রিসোর্ট সংস্কার ও সাজসজ্জার ব্যস্ততা দেখা যায়। কিন্তু এবার কোনো প্রাণচাঞ্চল্য নেই।
রিসোর্ট মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, ‘সবাই অনিশ্চয়তায়। যদি অন্তত তিন মাস রাত্রিযাপনের অনুমতি না দেওয়া হয়, তাহলে এই মৌসুমও আমাদের জন্য ধ্বংসাত্মক হবে।’
বেড়িবাঁধের দাবি
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখন ঘূর্ণিঝড় ও জোয়ারে দ্বীপের ঘরবাড়ি ও জমি প্লাবিত হয়। বাসিন্দারা সরকারের কাছে একটি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, আপাতত এমন কোনো প্রকল্প হাতে নেই।
সেন্ট মার্টিনের মানুষ এখন দুই দিক থেকে সংকটে—পর্যটক সীমিত, মাছ শিকারে ভয়। দ্বীপবাসী আশায় আছে, সরকার অন্তত পর্যটন মৌসুমে নিয়ম কিছুটা শিথিল করবে, যাতে তাদের জীবিকা টিকিয়ে রাখা যায়।
পূর্বের পোস্ট :