গাজা উপত্যকায় ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা বহনকারী গ্লোবাল সমুদ ফ্লোটিলাকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় আটকে দেওয়ায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া আটক মানবাধিকারকর্মীদের তাৎক্ষণিক ও নিঃশর্ত মুক্তি চেয়েছে ঢাকা। শুক্রবার (৩ অক্টোবর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমন তথ্য জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক জলসীমায় গ্লোবাল সমুদ ফ্লোটিলা আটক করার ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ন্যক্কারজনক বহিঃপ্রকাশ। আটক মানবাধিকারকর্মীদের নিরাপত্তা ও সুস্থতার নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান রেখে গাজা ও পশ্চিম তীরের ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্বের অবসান এবং গাজায় ইসরায়েলি অবরোধ ও গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, এই মানবিক সহায়তা বহনকারী জাহাজ অধিকারহীন ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশ্বব্যাপী একাত্মতার প্রতীক। গাজায় সমুদ ফ্লোটিলার নির্বিঘ্ন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে দখলকারী ইসরায়েলি বাহিনীর কারণে সাধারণ জনগণ এখনও তাদের জীবন, মর্যাদা ও জীবিকার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
দখলদার ইসরায়েলের নৌপ্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ও গাজায় ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে গত ৩১ আগস্ট স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। এ নৌবহরে প্রায় ৫০টি জাহাজ ছিল। এসব জাহাজে মানবাধিকারকর্মীসহ প্রায় ৪৪টি দেশের সাড়ে চারশ প্রতিনিধি ছিলেন।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার কিছু জাহাজ ইসরায়েল বুধবার, বাকিগুলো বৃহস্পতিবার আটক করে। প্রায় সবগুলো জাহাজই আটক করা হয়েছে আন্তর্জাতিক জলসীমা ও ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক জলসীমা থেকে।
উপকূলীয় দেশগুলো তাদের উপকূল থেকে নিকটবর্তী এলাকা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যেটাকে বলা হয় ‘আঞ্চলিক জলসীমা’। এই জলসীমা উপকূল থেকে ন্যূনতম ১২ নটিক্যাল মাইল (২২ কিলোমিটার) পর্যন্ত হয়। এর বাইরে অন্তত ২০০ নটিক্যাল মাইল (৩৭০ কিলোমিটার) পর্যন্ত অধিকার পাওয়া যায়, যেটাকে বলা হয় ‘একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল’ (ইইজেড)। এই জলসীমায় মাছ শিকার, খনিজ পদার্থ সংগ্রহ, ড্রিলিং এবং জ্বালানি সম্পর্কিত প্রকল্প নেওয়া যায়। তবে অন্যান্য দেশের নৌযান চলাচলে স্বাধীনতা থাকে।
২০১০ সাল থেকে একাধিক ফ্লোটিলা গাজার ব্লকেড ভাঙার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই ইসরায়েলের হামলার মুখে পড়েছে। সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০১০ সালের ৩১ মে। সেদিন ইসরায়েলের কমান্ডো বাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাভি মারমারায় অভিযান চালায়। তারা ১০ মানবাধিকারকর্মীকে হত্যা করে এবং কয়েক ডজনকে আহত করে। হতাহতদের অধিকাংশই তুরস্কের। এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ তৈরি হয় এবং ইসরায়েল ও তুরস্কের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
সমুদ্রের প্রায় ৬৪ শতাংশ এলাকা আন্তর্জাতিক জলসীমার অন্তর্ভুক্ত। কোনো দেশের আঞ্চলিক জলসীমা ও একচেটিয়া অর্থনৈতিক জলসীমা শেষ হবার পর আন্তর্জাতিক জলসীমা শুরু হয়। এটি কোনো একক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে না এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি মোতাবেক ব্যবহার করা হয়।
আন্তর্জাতিক জলসীমা ১৯৮২ সালের জাতিসংঘের সমুদ্র আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই আইন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক জলসীমায় যেকোনো দেশের নৌযান চলাচল করতে পারবে। এ জলসীমার ওপর দিয়ে বিমান চলাচলের স্বাধীনতাও রয়েছে। এছাড়া সাবমেরিন কেবল, পাইপলাইন, মাছ শিকার, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণও করা যায়, তবে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইনের আলোকে।
এই জলসীমায় চলাচল করা জাহাজে যে রাষ্ট্রের পতাকা থাকবে, ওই রাষ্ট্রেরই কর্তৃত্ব প্রযোজ্য। তবে জলদস্যুতা বা বেআইনি কর্মকাণ্ড ঘটলে কর্তৃত্ব সীমিত হতে পারে।
গাজায় দুর্ভিক্ষ চললেও উপত্যকায় কোনো ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি বাহিনী। আগস্টে ক্ষুধা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইপিসি জানিয়েছে, গাজার পাঁচ লাখ মানুষ অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশ ফিলিস্তিনি দুর্ভিক্ষে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাস-নেতৃত্বাধীন হামলার পর গাজায় যুদ্ধ শুরু হলে অবরোধ আরও কড়া হয়। ২০২৫ সালের মার্চে প্রায় তিন মাসের জন্য সম্পূর্ণ অবরোধ জারি হয়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সীমিত পণ্য প্রবেশ শুরু হয়।
একই সঙ্গে জাতিসংঘের খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা ভেঙে ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) নামের একটি মার্কিন গোষ্ঠীর নতুন খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা চালু করে ইসরায়েল। এতে ফিলিস্তিনিদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
পূর্বের পোস্ট :