জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে বসে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে আহ্বান জানানো হয়েছিল, সেটিরও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এ বিষয়ে আলোচনার জন্য জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগ সফল হয়নি। ছয়দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ নয় দলের নেওয়া উদ্যোগও অগ্রসর হয়নি। সমঝোতার জন্য সরকারের দেওয়া সাত দিনের সময়সীমা আগামীকাল (সোমবার) শেষ হচ্ছে। ফলে শেষ পর্যন্ত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারকেই দিতে হবে।
রাজনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, কার্যত বিএনপির অনাগ্রহেই দলগুলোর মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ এগোয়নি। বিএনপি এখন কোনো রাজনৈতিক পক্ষের উদ্যোগে আলোচনায় বসতে রাজি নয়। তবে সরকার উদ্যোগ নিলে তারা আলোচনায় অংশ নেবে—গত বৃহস্পতিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
৩ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। বৈঠক থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দিতে আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়, সরকার আলোচনার আয়োজন করবে না। এক সপ্তাহের মধ্যে দলগুলো ঐকমত্যে না পৌঁছাতে পারলে সরকার নিজ সিদ্ধান্ত নেবে।
এরপর বুধবার জামায়াতে ইসলামী আলোচনার জন্য দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে বিএনপির মহাসচিবকে ফোনে প্রস্তাব দেয়। তবে বিএনপি এতে সাড়া দেয়নি। উল্টো দুই দলের নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে উত্তেজনা বেড়েছে।
জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ আট দল অবিলম্বে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি ও জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে আগামী মঙ্গলবার ঢাকায় বড় সমাবেশের ডাক দিয়েছে। দাবিগুলো মানা না হলে সমাবেশ থেকে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে তারা।
গত বৃহস্পতিবার ওই সমাবেশে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সোজা আঙুলে যদি ঘি না ওঠে, আঙুল বাঁকা করব।’
জামায়াতের প্রস্তাব বিএনপির নাকচ করার বিষয়টি নিয়ে আট দলের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়। সেখানে নেতারা বলেন, বিএনপি আহ্বান জানালে তাঁরা দেশ ও জাতির স্বার্থে আলোচনায় অংশ নেবেন।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জামায়াতের আলোচনার প্রস্তাবে প্রশ্ন তোলেন। শনিবার ঢাকায় ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যদি আমাদের আহ্বান জানায় কোনো বিষয়ে আলোচনার জন্য, আমরা আগ্রহী। কিন্তু অন্য কোনো রাজনৈতিক দল কেন আমাদের আহ্বান জানাবে?’
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনতে গণতন্ত্র মঞ্চসহ নয় দল পৃথকভাবে আলোচনা শুরু করলেও তাতে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘বিএনপির মহাসচিবকে আহ্বান জানানো হয়েছে, কিন্তু তাঁরা বলেছেন, জামায়াতের আহ্বানে তাঁরা সাড়া দেবেন না। বিগত রেজিম (পতিত শেখ হাসিনা) সব সময় এমন বলত—অমুকের সঙ্গে বসবে না। আমরা কি এখনো সেই সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারিনি? বিএনপি আহ্বান জানালে জামায়াত অবশ্যই যাবে এবং অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করবে।’
বিএনপি ও জামায়াতের এমন অনড় অবস্থানে সমঝোতার সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘সবাই সমঝোতা চায়, কিন্তু সবাই গরম বক্তৃতা দেয়। কেউ আলোচনায় বসবে না, আবার কেউ আঙুল বাঁকা করবে—এভাবে কীভাবে সমঝোতা হবে?’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সরকারি মধ্যস্থতা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগে কোনো সমঝোতা বাস্তবসম্মত নয়।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছিল। পরে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে অনুরোধ জানানো হয়। গণতন্ত্র মঞ্চ তখন এনসিপি, এবি পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদকে নিয়ে উদ্যোগ নিয়েছিল, তবে তাতেও ফল আসেনি।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম বলেন, ‘সংস্কার নিয়ে সরকারের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। কিন্তু দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে গণতন্ত্র মঞ্চ এর আগেও আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল, এবারও নিয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, তবে বড় দলগুলোকে কিছু ছাড় দিতে হবে।’
পূর্বের পোস্ট :