স্বাস্থ্য খাতে নিয়মিত ও সুপারনিউমারারি পদোন্নতি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু চিকিৎসক নিয়মিত পদোন্নতি থেকে বাদ পড়েছেন, আবার কয়েক শ চিকিৎসক সুপারনিউমারারি পদেও পদোন্নতি পাননি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, যাঁরা পদোন্নতি পাননি, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। তবে চিকিৎসক সমাজ বলছে, এই প্রক্রিয়ায় দলীয় রাজনীতি প্রভাব ফেলছে।

অন্যদিকে, যাঁরা পদোন্নতি পেয়ে কাজে যোগও দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সাতজনের পদোন্নতি পরে বাতিল করেছে মন্ত্রণালয়। এসব চিকিৎসক বলছেন, কোনো কারণ না জানিয়ে পদোন্নতি বাতিল করা হয়েছে—এটা অন্যায়। তবে মন্ত্রণালয়ের দাবি, পদোন্নতিগুলো ‘ভুলবশত’ দেওয়া হয়েছিল।

রাজনৈতিক বিভাজন ও প্রভাব

২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতে প্রভাব বিস্তার করেছিল আওয়ামী লীগ–সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)। গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে ছিলেন সংগঠনের সদস্যরা। তাঁদের পদোন্নতি, ছুটি, বিদেশগমন ও গবেষণার সুযোগে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো।

এর বিপরীতে বিএনপি–সমর্থিত ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), জামায়াত–সমর্থিত ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম (এনডিএফ) এবং নির্দলীয় চিকিৎসকেরা কোণঠাসা অবস্থায় ছিলেন। পদোন্নতি ও স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হন অনেকে।

সরকার পরিবর্তনের পর এখন স্বাচিপ–সম্পৃক্ত চিকিৎসকেরা বিপাকে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মেডিকেল কলেজগুলোতে তাঁদের অনেককে বদলি, ওএসডি বা অবসরে পাঠানো হয়েছে।

পদোন্নতির নতুন ধারা

চিকিৎসা খাতে স্থবিরতা কাটাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সাড়ে সাত হাজার চিকিৎসককে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এতে একাধিক বিষয়ে একসঙ্গে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে, যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফর বলেন, ৮২টি বিষয়ে সাড়ে সাত হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

তবে গত দু-তিন মাসে নিয়মিত পদোন্নতিতে সুযোগ পেয়েছেন ৭৬৮ জন, বাদ পড়েছেন ১৩০ জন চিকিৎসক। তাঁদের বেশির ভাগের নাম স্বাচিপের তালিকায় ছিল।

পদোন্নতি বঞ্চনা ও অভিযোগ

চিকিৎসক সূত্রগুলো জানায়, ড্যাব ও এনডিএফের সদস্যদের পদোন্নতিতে বড় কোনো সমস্যা হয়নি। তবে অভিযোগ উঠেছে, সংগঠনগুলোর কিছু নেতা মন্ত্রণালয়ে চাপ দিয়ে স্বাচিপ–সম্পর্কিত চিকিৎসকদের পদোন্নতি আটকে দিয়েছেন।

ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয়কে কাউকে বাদ দিতে বলিনি। ভুল-ত্রুটি থাকলে মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই তা শুধরে নেবে।’

এনডিএফ সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলামও জানান, তাঁদের পক্ষ থেকে পদোন্নতিতে কোনো প্রভাব খাটানোর চেষ্টা হয়নি।

ব্যক্তিগত বিড়ম্বনা

পদোন্নতি না পাওয়া চিকিৎসকেরা অভিযোগ করছেন, তাঁরা অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। কেউ কেউ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আবেদন করছেন, কারওাা পদোন্নতির জন্য প্রভাবশালী ব্যক্তির সহায়তা নিচ্ছেন।

চট্টগ্রামের এক নারী চিকিৎসক বলেন, ‘আমার ছাত্রীকে পদোন্নতি দিয়ে আমার ওপরে বসানো হয়েছে। আমি লজ্জায় কলেজে যেতে পারছি না, বাসাতেও মুখ দেখাতে পারছি না।’

সাত চিকিৎসকের পদোন্নতি বাতিল

গত ২২ অক্টোবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গাইনি অ্যান্ড অবস বিষয়ে ৫৯৯ জন চিকিৎসককে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেয়। কিন্তু পরদিন সাতজনের পদোন্নতি বাতিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়।

পদোন্নতি বাতিল হওয়া চিকিৎসকেরা বলছেন, তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে তাঁরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসচিব মো. সাঈদুর রহমান বলেন, ‘ওই সাতজনকে ভুলবশত পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।’

চিকিৎসক সমাজের একাংশ মনে করছে, পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব স্বাস্থ্যখাতের ন্যায়বিচার ও প্রশাসনিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। এতে চিকিৎসা শিক্ষা ও জনসেবার গুণগত মানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর।