ঢাকার সাভারের খাগান এলাকায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর গোটা এলাকাজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

রাতভর সংঘর্ষের পর সোমবার সকালে সিটি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেছে, ভবনের দেয়াল ও কাচ ভাঙা, আসবাবপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে, কোথাও কোথাও এখনো ধোঁয়া উঠছে।

সিটি ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি চারটি আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের সোমবার সন্ধ্যার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা উজ্জল সরকার অভিযোগ করেন, ‘ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। তারা গানপাউডার নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে গেটে আগুন দেয় এবং অ্যাকাউন্টস অফিস লুট করে।’

কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, হামলা-ভাঙচুরে তাদের ২০–২৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আরাফাতুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। বাইরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। ভিতরে কী অবস্থা, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

ঘটনাটির সূত্রপাত

রোববার সন্ধ্যায় থুতু ফেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীর শরীরে অসর্তকতাবশত থুতু লাগলে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। পরে রাত ৯টার দিকে সিটি ইউনিভার্সিটির প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী লাঠিসোঁটা নিয়ে ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীদের ভাড়া করা বাসায় হামলা চালায়।

এর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে সিটি ইউনিভার্সিটির দিকে অগ্রসর হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

দুই পক্ষের বক্তব্য

সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘রোববার রাতে থুতু ফেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। বিষয়টি রাত ১০টার দিকে সমাধান হলেও ভোর পর্যন্ত ড্যাফোডিলের অসংখ্য শিক্ষার্থী হামলা চালায়।’

অন্যদিকে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, ‘অসর্তকতাবশত থুতু পড়ার ঘটনায় “সরি” বলেই বিষয়টি মিটে গিয়েছিল। কিন্তু রাতে ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীদের মেসে হামলা কাম্য নয়।’

সিটি ইউনিভার্সিটির প্রক্টর অধ্যাপক আবু জায়েদ বলেন, ‘এটি পরিকল্পিত হামলা। আমাদের শিক্ষার্থীদের অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন।’

ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র

রাতভর সংঘর্ষে অন্তত তিনটি বাস, পাঁচটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেট কারে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সকালেও কিছু গাড়ি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। ভবনের জানালা, দরজা, কম্পিউটার, আসবাবপত্র, এমনকি বাথরুমের বেসিন পর্যন্ত ভাঙা পড়ে ছিল।

সিটি ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী জানান, ‘ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের ওপর হামলা হয়েছে। মেয়েদের হলে কলাপসিবল গেটে ইট ছোঁড়া হয়েছে।’

ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বিমল চন্দ্র দাস ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে এমন ধ্বংসযজ্ঞ হতে পারে, এটি কল্পনাতীত। দায়ীদের শাস্তি হওয়া উচিত।’

প্রশাসনের সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ

সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, ‘রাতভর প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েও পাইনি। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে এসেও নীরব ছিল।’

সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের ২৫–২৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, শতাধিক আহত। পুলিশকে জানিয়েও কোনো সহযোগিতা পাইনি।’

আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি

সংঘর্ষের পর সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ড্যাফোডিলের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটকে রাখেন। পরে উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনায় নয়জনকে মুক্তি দেওয়া হয়।

ড্যাফোডিলের প্রক্টর শেখ মুহাম্মদ আলিয়ার জানান, তাদের প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য বলেন, ‘যাদের ধরা হয়েছে তারা ভাঙচুরের সময় ধরা পড়েছে। আমরা মনে করি, তারা শুধু শিক্ষার্থী নয়, কেউ কেউ লুটতরাজেও যুক্ত।’

ক্ষয়ক্ষতি ও তদন্ত

সিটি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান দাবি করেন, হামলাকারীরা পরিকল্পিতভাবে অফিসকক্ষে প্রবেশ করে ভিসি, প্রোভিসি ও রেজিস্ট্রারের কম্পিউটার ভেঙেছে, গুরুত্বপূর্ণ নথি লুট করেছে।

তিনি বলেন, ‘সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণ ২০–২৫ কোটি টাকা হতে পারে। এ ঘটনায় আমরা তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

সোমবার দুপুর পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি, তবে দুই পক্ষই মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।