বড় কোনো গোলযোগ ছাড়াই উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু), হল ও হোস্টেল সংসদের ভোটগ্রহণ।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি ভবন, নতুন কলা ভবন, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও বাণিজ্য (বিবিএ) অনুষদ ভবনের ৬০টি কক্ষে প্রায় ৭০০ বুথে একটানা ভোটগ্রহণ হয়। সকাল ৯টায় ভোট শুরুর কথা থাকলেও শুরু হতে বিলম্ব হয় আধা ঘণ্টা। তবে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের ভোট শুরু হয় বেলা সাড়ে ১১টার পর।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন জানান, ‘ধীরগতিতেও হোক, বিকেল ৪টা পর্যন্ত কেন্দ্রের চৌহদ্দিতে যারা থাকবেন, সবার ভোট নেওয়া হবে।’
বিকেল ৪টার পরও বিভিন্ন কেন্দ্রে কয়েকজন ভোটারকে ভোট দিতে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তবে বাণিজ্য অনুষদ ভবনের নিচতলায় কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, যখন ভোট শেষে কেউ কেউ কেন্দ্রে প্রবেশের চেষ্টা করেন।
ভোটগ্রহণ শেষ না হওয়ায় ফলাফল ঘোষণায় কিছুটা বিলম্ব হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক কামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমরা শতভাগ স্বচ্ছতা বজায় রেখে ভোট গণনা শেষ করতে চাই। এজন্য যতটুকু সময় প্রয়োজন, সেটুকু নেওয়া হবে।’
শিক্ষার্থীদের ভোটের উচ্ছ্বাস
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জীবনের প্রথম ভোট দিতে পেরে দারুণ উচ্ছ্বসিত। সকাল থেকেই শাটল ট্রেন ও বিশেষ বাসে করে নগরী থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আসেন।
মেরিন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের ভোটার হলেও ভোট দিতে পারিনি। এবার নিজেদের নির্বাচনে ভোট দিতে পেরে আনন্দ লাগছে।’
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাজিদা তুজ শিমলি বলেন, ‘স্কুলে ভোট দিয়েছিলাম, কিন্তু বড় পরিসরে এই প্রথম ভোট দিলাম। পরিবেশটা চমৎকার, প্রচারণার সময়টাও উপভোগ করেছি।’
নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী উমামা করিম বলেন, ‘এটা আমাদের প্রথম ভোট। খুব আনন্দ লাগছে, যেন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের অংশ হয়েছি।’
দৃষ্টিহীনদের ভোটে বিলম্ব ও ক্ষোভ
দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের ভোট শুরু হয় বেলা সাড়ে ১১টার পর। তাদের জন্য বিশেষ ব্যালটের ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের আয়েশা আক্তার বলেন, ‘আমরা ব্রেইল ব্যালট চেয়েছিলাম, কিন্তু প্রশাসন শেষ পর্যন্ত তা করেনি। ফলে আমরা নিশ্চিত নই, আমাদের ভোট কাঙ্ক্ষিত প্রার্থীর পক্ষে পড়েছে কিনা।’
বহিরাগত প্রবেশের অভিযোগ
ভোট শুরুর দেড় ঘণ্টার মাথায় ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশের অভিযোগ তোলে ইসলামী ছাত্রশিবির ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
শিবির সমর্থিত সম্প্রীতির জোটের ভিপি প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন রনি বলেন, ‘কিছু ব্যক্তি কার্ড ছাড়া কেন্দ্রে ঘুরছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন। আমরা চাই নির্বাচন কমিশন দ্রুত ব্যবস্থা নিক।’
ছাত্রদলের এজিএস প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান তৌফিক বলেন, ‘বৈধ পাস ছাড়া যেন কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে না ঢোকে, সেটা আমরা আগেই বলেছি। এর দায় প্রশাসনের।’
এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন বলেন, ‘যাদের কার্ড নেই, তারা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। যদি এমন কেউ থাকে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
‘অমোচনীয়’ কালি নিয়ে বিভ্রান্তি
ভোটার চিহ্নিতকরণে ব্যবহৃত অমোচনীয় কালি মুছে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন প্যানেলের পক্ষ থেকে।
ছাত্রদলের প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান তৌফিক বলেন, ‘কালি মুছে যাচ্ছে, এতে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। প্রশাসন আরও ভালো মানের কালি দিতে পারত।’
এ প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মনির উদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের ব্যবহৃত জার্মান কালি আমরা পাইনি। তাই বিকল্প কালি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে ভোটার শনাক্তে কোনো সমস্যা হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ভোটার তালিকায় ছবি ও আইডি নম্বর আছে। পোলিং এজেন্টরা তা যাচাই করবেন। তাই কালি এখন আর বাধ্যতামূলক নয়।’
নিরাপত্তা ও প্রশাসনের তৎপরতা
সকাল থেকে ক্যাম্পাসে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি ছিল। বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে।
ভোটের সময় উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার বলেন, ‘এই নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ ও রিহার্সাল হিসেবে কাজ করবে।’
উপ-উপাচার্য কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা ছবিসহ ভোটার তালিকা এবং পর্যাপ্ত ওএমআর মেশিন ব্যবহার করেছি, যাতে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে ভোট গণনা সম্পন্ন করা যায়।’
ভোটের হার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এ নির্বাচনে ভোটার। দুপুর পর্যন্ত চারটি কেন্দ্রে ভোটের হার ছিল ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে।
বিজ্ঞান অনুষদ কেন্দ্রে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। কলা অনুষদে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদে ৪২ শতাংশ এবং আইটি ভবনে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে।
সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে সম্পন্ন হলেও দৃষ্টিহীন ভোট, বহিরাগত প্রবেশ ও ‘অমোচনীয়’ কালি নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। ফল ঘোষণার অপেক্ষায় এখন পুরো ক্যাম্পাস।
পূর্বের পোস্ট :