ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নিজ আশাবট। এই গ্রামের একটি কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর, উন্নয়ন এবং সুপেয় পানি সরবরাহের নামে জেলা পরিষদ একে একে আটটি ছোট প্রকল্প নিয়েছে—বরাদ্দ মোট ২৪ লাখ টাকা। কাগজে-কলমে কবরস্থানটিকে ‘সামাজিক কবরস্থান’ বলা হলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এটি স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর পারিবারিক কবরস্থান।

জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন সরদারের ইচ্ছায় এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জেলা পরিষদের কর্মকর্তাদের দাবি, সচিবকে ‘সন্তুষ্ট’ রাখতেই এই কাজ করেছেন তিনি।

জেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কম্বল বিতরণে অনিয়ম, প্রশাসকের স্বাক্ষর জালিয়াতি এবং এক কবরস্থানের জন্য টানা একাধিক প্রকল্প গ্রহণসহ কবির হোসেনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছেন। ২৬ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগে তাঁরা লিখিত অভিযোগ দেন। এর পরদিনই তাঁকে ময়মনসিংহ থেকে বদলি করা হয়—প্রথমে পটুয়াখালী, পরে নেত্রকোনা জেলা পরিষদে।

ভুলভাবে বিশ্রী অবস্থা করেছে’ — সচিব

স্থানীয় সরকার সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বলেন, তিনি কখনো কবরস্থানের কাজে প্রকল্প দিতে বলেননি। ‘ছোট কাজে’ নির্দেশ দিয়েছিলেন—জনগণের জন্য পানির ব্যবস্থা ও একটি পাঞ্জেখানা মসজিদের উন্নয়নের জন্য।

তিনি বলেন, ‘ছোট কাজ করতে বললাম, আর জেলা পরিষদ ভুলভাবে এটা করে বিশ্রী অবস্থা করেছে। আমি এখন এটি বাদ দিতে বলেছি।’

তিনি জানান, অভিযোগ জানার পরই কবির হোসেনকে বদলি করা হয়েছে এবং তাঁকে অন্য জায়গায় সরানো হচ্ছে।

এক গ্রামে ৯ প্রকল্প

জেলা পরিষদের নথি অনুযায়ী, ১৮ মে স্থানীয় সরকার বিভাগের ৯০ লাখ টাকার অনুদান থেকে মোট ৩৭ প্রকল্প নেওয়া হয়। ফুলপুর উপজেলায় নেওয়া ১০ প্রকল্পের ৯টিই নিজ আশাবট গ্রামে—প্রতিটির বরাদ্দ ৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৮টি প্রকল্প সচিবের পারিবারিক কবরস্থান ঘিরে।

গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, কবরস্থানের সীমানাপ্রাচীর, মোটর স্থাপন, পানির ট্যাংক ও স্যানিটেশন সুবিধার কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। সাইনবোর্ডে স্পষ্ট লেখা—‘পারিবারিক কবরস্থান’। স্থানীয় বাসিন্দারাও জানিয়েছেন, এটি সবার জন্য উন্মুক্ত কোনো সামাজিক কবরস্থান নয়।

কম্বলে নয়ছয়

২০২৪–২৫ অর্থবছরে দুস্থ মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য প্রায় ৫০ লাখ টাকার কম্বল কেনায়ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে কবির হোসেনের বিরুদ্ধে। কার্যাদেশ অনুযায়ী ১২ হাজার কম্বল সাত দিনের মধ্যে সরবরাহ হওয়ার কথা থাকলেও জেলা পরিষদের প্রকৌশলী জানিয়েছেন—‘একটি কম্বলেও আমরা বুঝে পাইনি।’

তবু ‘বিতরণ হয়েছে’—এমন কাগজপত্র কবির হোসেন দপ্তরে জমা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

প্রশাসকের স্বাক্ষর জালিয়াতি

বর্তমান প্রশাসক তাহমিনা আক্তারের স্বাক্ষর জাল করে প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ টাকার প্রকল্পের কার্যবিবরণী তৈরি করেছেন কবির হোসেন—এমন অভিযোগের পর তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

কবির হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, প্রকল্পগুলো সভায় অনুমোদনের পর মন্ত্রণালয় থেকে আসে, কোনো সমস্যা হলে পরিবর্তন করা হয়।

দুদকের তদন্ত শুরু

জেলা পরিষদের রাজস্ব বাজেটে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেখিয়ে অর্থ লুটপাটের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করেছে। বিভাগীয় প্রশাসনও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে।

ময়মনসিংহ জেলা পরিষদে স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও জালিয়াতির এসব অভিযোগ এখন স্থানীয় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে—আর এর বড় অংশ জুড়েই রয়েছে সচিবের পারিবারিক কবরস্থানের জন্য নেওয়া আট প্রকল্প।